গোয়েন্দা নজরদারিতে প্রশাসনের কর্মকর্তারা

চলমান দুর্নীতি ও মাদকবিরোধী অভিযানে কঠোর নজরদারিতে রয়েছেন প্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। বিভিন্ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) কাজকর্ম খতিয়ে দেখছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। এসব প্রকল্পে দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্নিষ্টদের তালিকাও তৈরি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকটি সংস্থার কর্মকর্তাদের দুর্নীতি-সংক্রান্ত প্রতিবেদনও দেওয়া হয়েছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকেও স্ব-উদ্যোগে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজকর্মে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি-না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সম্প্রতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নের জন্য সচিব, বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসিদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। দুর্নীতিমুক্ত দেশগুলোর প্রচলিত পদ্ধতি সংগ্রহ করে ধারণাপত্রও তৈরি করেছে সরকার। এ ধারণাপত্র অনুযায়ী দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সমকালকে এসব কথা জানিয়েছেন।

এদিকে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনায় প্রশাসনে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অনেকেই আয়করের নথিতে উল্লেখিত তথ্যের সঙ্গে তাদের অর্থ-সম্পত্তির মিল রয়েছে কি-না, তা খুঁজে দেখছেন। কেউ কেউ প্রশিক্ষণ ও অফিসের অন্যান্য কাজের অজুহাতে বিদেশ যাচ্ছেন বা যেতে চাইছেন।

দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) সার্বিক কার্যক্রম এখন প্রতিনিয়তই অনলাইনে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যেসব প্রকল্পে ব্যয় বাড়লেও কাজের অগ্রগতি হয়নি কিংবা নামমাত্র বাস্তবায়ন হয়েছে, এমন প্রকল্পের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে শিগগিরই অভিযান শুরু হবে। শুধু বড় বড় প্রকল্প নয়, মন্ত্রণালয় ও বিভাগের যে কোনো কেনাকাটার হিসাবনিকাশ খতিয়ে দেখা হবে। কোনো জিনিসের বাস্তবে কী দাম এবং সেটি কত দিয়ে কেনা হয়েছে- সে বিষয়ে অনুসন্ধান চালাবে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া অব্যাহতভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানে এক ব্যক্তিই ঠিকাদারি কাজ পেলে তিনি তা কোন প্রক্রিয়ায় পেয়েছেন, তার সঙ্গে প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তার যোগসাজশ আছে কি-না, এসব খতিয়ে দেখা হবে এবং অনিয়ম পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান গত ১০ বছর গণপূর্ত অধিদপ্তরে কী কী কাজ করেছে, তার দরপত্র ও কার্যাদেশের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি-না, অনিয়ম হলে তার সঙ্গে কারা জড়িত- এসব জানতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্নিষ্ট অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে কিংবা যারা এ ধরনের অপরাধে যুক্ত, তাদের সুনির্দিষ্ট তালিকা করে ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রক্রিয়া চলছে। প্রশাসনের যারা বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, বিশেষত গত ১০ বছরে নিয়োগ-বাণিজ্য করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও অভিযান শুরু করার পথে এগোচ্ছে সরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অনেক আগেই শুরু হয়েছে। এখন এগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে। এতে জনগণের ইতিবাচক সাড়াও মিলছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির শাস্তি হিসেবে অনেকের পদোন্নতি আটকে রাখা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালকরা অনলাইনে সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ে রয়েছেন।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারেও দুর্নীতিমুক্ত জনপ্রশাসন গড়ে তোলার অঙ্গীকার ছিল। সরকার চাইছে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ব্যুরোক্রেসি। এ জন্য দুর্নীতিবাজ কোনো কর্মকর্তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। দুর্নীতির কারণে সরকারের সব উন্নয়ন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী তাই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন।

ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই সম্পদের হিসাব দেন। আবার অনেকে দেন না। এবার প্রত্যেকের সম্পদের হিসাব নেওয়ার কাজ চলছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন প্রতিবছর আয়কর রিটার্ন জমা দেন। এ ক্ষেত্রে কেউ সম্পদের হিসাব গোপন করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য চূড়ান্ত ধারণাপত্র জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুই মাস অন্তর মূল্যায়ন প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। শুরুতে কর্মকর্তারা যার যার মূল্যায়ন প্রতিবেদন দেখে সংশোধনের সুযোগ পাবেন। এরপর কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এসব কারণে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা চরম অস্বস্তিতে রয়েছেন। তারা সরকারের এই অভিযান বন্ধের নানা কৌশল খুঁজছেন।

সম্প্রতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাস্তবায়ন কমিটির বৈঠকেও সরকারি কিছু অফিসকে পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত ঘোষণা করার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তাদের অনেকে এ বিষয়ে দ্বিমত করেন। তারা বলেন, কোনো কারণে দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারলে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের এ উদ্যোগ বিতর্কিত হতে পারে। ফলে এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

এদিকে, আমলাদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার উদ্যোগের শুরুতেই প্রশাসনে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও এ বিধান মানতে চাইছে না দুর্নীতিবাজ শীর্ষ আমলাদের একাংশ। তারা বলছেন, কর্মচারীদের এই বিধিমালা সেকেলে এবং বর্তমানে তা প্রতিপালনযোগ্য নয়। কারণ, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন আয়কর রিটার্ন জমা দেন এবং প্রত্যেকের ব্যক্তিগত টিন নম্বর রয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা প্রতিপালনযোগ্য। কারণ, বিধানটি রাষ্ট্রপতির আদেশে জারি হয়েছে। এটা বাতিল করার আগ পর্যন্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করা বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া আয়কর রিটার্নে কর্মকর্তাদের পুরো সম্পত্তির হিসাব পাওয়া যায় না। তথ্য গোপনেরও সুযোগ রয়েছে। অবশ্য এ বিতর্কের মধ্যেই ভূমি মন্ত্রণালয় কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব চেয়ে জনপ্রশাসনে চিঠি দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, দুদকের কাজই হলো সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে। তাই দুদকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি আসে। এ কারণে সব সরকারি দপ্তরে দুদকের নজরদারি আছে। প্রধানমন্ত্রী যেমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে, দুদকও তেমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সময় অনুযায়ী অ্যাকশন শুরু হবে।

দুদক এবং অভিযান-সংশ্নিষ্ট কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দেশকে সত্যিকার অর্থেই দুর্নীতি ও মাদকমুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অটল। এ ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি নেওয়া হয়েছে এবং ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে অভিযান শুরু হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিষয়ে দুদককে কঠোর ব্যবস্থাও নিতে বলা হয়েছে। দুদক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সুনির্দিষ্ট তালিকাও তৈরি করেছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশের সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব রয়েছে। এসবের মধ্যে দুর্নীতি ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ ও কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না- প্রধানমন্ত্রী এ দুটি বিষয় স্পষ্ট করে বলেছেন। এমন অভিযানে কোনো পেশা বা খাতকে বাদ না দেওয়ার ঘোষণা দেশের জন্য ভালো খবর। যারা এ অভিযান বাস্তবায়ন করছেন, তাদেরও প্রধানমন্ত্রীর কথা দুটি মনে রাখতে হবে। নিরপেক্ষভাবে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তবে এর সফলতার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমন অভিযানের সফলতা এক মাসেই আশা করা যায় না।

এ বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি চিঠি পেয়েছি। ওই চিঠির নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তরগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারি খাতে দুর্নীতি বন্ধের বাস্তব পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তাদের সতর্ক করেও চিঠি দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ঠাকুরগাঁও জেলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. কে এম কামরুজ্জামান সেলিম বলেন, মাঠ প্রশাসনের সর্বস্তরে সুশাসন নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা পেয়েছি। সেই নির্দেশনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (ইউএনও) সংশ্নিষ্ট সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। জেলা কো-অর্ডিনেশন বৈঠকেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। মাঠ প্রশাসনেও জিরো টলারেন্স নীতির ভিত্তিতে কাজ শুরু হয়েছে। সূত্র : সমকাল

Share this post

scroll to top