আনিসুর রহমানের মেয়ে রাজধানীর মতিঝিল কলোনিতে অবস্থিত একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তিনি জানান, স্কুলটিতে বছরে প্রথম সাময়িক ও বার্ষিক পরীক্ষা রয়েছে। এ ছাড়া প্রতি পরীক্ষার আগে প্রতি বিষয়ে একটি করে ক্লাস টেস্ট নেয়া হয়। কিন্তু ক্লাস টেস্ট পরীক্ষায়ও ফি নেয়া হয়। মূল পরীক্ষায় যে ফি তার অর্ধেক নেয়া হয় ক্লাস টেস্টে। ক্লাস টেস্ট হয় মোট ৪০ নম্বরের।
রাজধানীর অন্যান্য স্কুলের অভিভাবকদের সাথে কথা বলে বেসরকারি স্কুলে পরীক্ষা গ্রহণ বিষয়ে যে চিত্র পাওয়া গেছে তাতে আনিসুর রহমানের ভাগ্য অনেক ভালো বলতে হয়। কারণ তার মেয়ের প্রতি বিষয়ে বছরে মাত্র দু’টি ক্লাস টেস্ট নেয়া হয়। রাজধানীর বনশ্রীতে অবস্থিত নামকরা একটি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন অভিভাবক জানান, তার ছেলের প্রতি বিষয়ে প্রতি পরীক্ষার আগে ছয়টি করে ক্লাস টেস্ট নেয়া হয়। সে হিসেবে প্রতি বিষয়ে বছরে ১২টি ক্লাস টেস্ট হয়।
তিনি বলেন, দ্বিতীয় শ্রেণীতে মোট তিনটি সরকারি পাঠ্যবই রয়েছে। এর বাইরে স্কুল থেকে ধর্ম বিষয়ে একটি বই পাঠ্য করা হয়েছে। মোট চার বিষয়ে ক্লাস টেস্ট নেয়া হয়। স্কুলে প্রথম সাময়িক ও বার্ষিক পরীক্ষা নামে দুটি মূল পরীক্ষা রয়েছে। প্রতি পরীক্ষার আগে প্রতি বিষয়ে ছয়টি করে ক্লাস টেস্ট হিসেব করলে বছরে ৪৮টি ক্লাস টেস্ট নেয়া হয় চার বিষয়ে। এ ছাড়া দুটি মূল পরীক্ষা। এভাবে বছরে কমপক্ষে ৫০টি পরীক্ষা নেয়া হয় তাদের।
এক প্রশ্নের জবাবে এ অভিভাবক জানান, প্রতি ক্লাস টেস্ট নেয়া হয় ১০ নম্বরের। এ জন্য কোনো পরীক্ষার ফি নেয়া হয় না। ক্লাস টেস্টের নম্বর মূল পরীক্ষায় যোগ করে মেধা তালিকা প্রস্তুত করা হয়।
রাজধানীর বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলে নার্সারি থেকেই পরীক্ষা গ্রহণ শুরু হয়। তুলনামূলক একটু ভালো বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল মানেই সারা বছর পরীক্ষা আর পরীক্ষা। কোথাও কম কোথাও বেশি। অনেক স্কুলে ক্লাস টেস্ট ছাড়াও প্রতি পরীক্ষার আগে প্রতি বিষয়ে একাধিকবার মডেল টেস্ট নেয়া হয়। সে হিসেবে অনেক স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীকে বছরে অর্ধ শতাধিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। আর তৃতীয় শ্রেণী থেকে উপরের শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বছরে দিতে হয় শতাধিক পরীক্ষা।
কারণ তৃতীয় শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীর জন্য সরকারি পাঠ্যবই ছয়টি। ছয় বিষয়ে শুধু ক্লাস টেস্টই নেয়া হয় ৭২টি। এ ছাড়া অনেক স্কুলে রয়েছে এর বাইরে অতিরিক্ত পাঠ্যবই। সেগুলোতেও ক্লাস টেস্টসহ মডেল টেস্ট নেয়া হয়। এভাবে সবসময় পরীক্ষার চাপে রাখা হয় কোমলমতি শিশুদের। পরীক্ষার কারণে চাপে থাকেন মা-বাবাও। আর পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য মা-বাবা চাপ সৃষ্টি করেন শিশুদের ওপর। এভাবে পরীক্ষা ঘিরে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা।
একজন অভিভাবক বলেন, ক্লাস টেস্ট ১০ নম্বরের হলেও সেটা পরীক্ষা। আর পরীক্ষা মানেই একটি চাপ আর ভালো নম্বরের জন্য প্রতিযোগিতা। প্রতি বিষয়ে এত বেশি ক্লাস টেস্ট হওয়ার কারণে প্রায় সারা বছর প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রাখতে হয় বাচ্চাদের। বাচ্চাদের কারণে অভিভাবকদেরও চাপে থাকতে হয়। অধিক পরীক্ষার কারণে সারা বছর মানসিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কোনো পরীক্ষায় নম্বর কম পেলে উদ্বিগ্ন হয় মা-বাবা। নম্বর কম পাওয়ার জন্য অনেক বাচ্চা মা বাবার কাছেই শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়। আর পড়া আদায় ঘিরে তো নিয়মিত তারা শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয় পরিবারে।
তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীর অভিভাবক আনিসুর রহমান বলেন, স্কুলের মূল পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় মাত্র দেড় ঘণ্টায়। অথচ পরীক্ষায় যে প্রশ্ন আসে তা আমরা লিখলেও দুই ঘণ্টা লাগবে। অথচ এত ছোট বাচ্চাদের সময় দেয়া হয় দেড় ঘণ্টা। তার ওপর পরীক্ষায় আসে সৃজনশীল প্রশ্ন। আনিসুর রহমান বলেন, পরীক্ষায় সময় স্বল্পতার কারণে তার মেয়ে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় ঠিক মতো সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। পরবর্তীতে অন্য অভিভাবকরাও অভিযোগ করায় সময় দুই ঘণ্টা করা হয়েছে। আনিস ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একে তো অতিরিক্ত পরীক্ষা, তারপর পরীক্ষায় প্রশ্ন করা হয় খুব কঠিন। এ অবস্থায় তাদের দেয়া হয় না উপযুক্ত সময়। এত চাপ শিশুরা সহ্য করবে কেমন করে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে পরীক্ষা না নেয়ার কথা বলা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়নের পর প্রায় এক দশক পার হতে চলছে কিন্তু আজ অবধি বাতিল করা হয়নি এ পরীক্ষা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী চলতি বছর মার্চ মাসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়Ñ তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দেয়া হবে। এ ঘোষণায় অনেক অভিভাবক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও এটি বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় নেয়া এবং নতুন করে মূল্যায়ন পদ্ধতি চালুর সিদ্ধান্তে অনেকে শঙ্কিত। মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ ঘোষণায় বলা হয়েছে ২০২১ সাল থেকে সারা দেশে তুলে দেয়া হবে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা।