ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে বড় ছেলেদের দেয়া প্রাণনাশের হুমকীতে আতঙ্কে দিন কাটছে এক মায়ের। উপজেলার মধুপুর গ্রামে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন ওই মা। এ প্রতিবেদকের কাছে নিজের অসহায়ত্বের কথা বলতে গিয়ে বার বার ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন ওই বৃদ্ধা মা।
জানা যায়, উপজেলার মগটুলা ইউনিয়নের মধুপুর গ্রামের মৃত জুমর আলীর স্ত্রী সামেরন্নেছা (৮২) পাঁচ ছেলে ও তিন কন্যাসন্তানের জননী। প্রায় ৩০ বছর আগে মারা যান তার স্বামী জুমর আলী। স্বামী মারা গেলেও এর মধ্যে সুখেই চলছিল সন্তানদের নিয়ে। বড় ছেলে তারা মিয়া ও মেঝো ছেলে সোবান ও সরুজ মিয়া বিয়ের পর পৃথক সংসার গড়লে ছোট দুই ছেলে মস্তুফা ও মোহাম্মদ আলীকে নিয়ে বেশ ভালোই চলছিলেন।
মস্তুফা ও মোহাম্মদ আলী দীর্ঘ ২০ বছর এক সাথে থাকার পর যৌথ আয়ে প্রায় ৫০ শতক জমি কিনেন। মোহাম্মদ আলীর লেখাপড়া না থাকায় বড় ভাই মস্তুফা সেই জমি নিজের নামে লিখে নেন।
পরবর্তীতে যখন মোহাম্মদ আলী জানতে পারেন তখন এলাকায় সালিশ ডাকা হয়। ওই সালিশে মাতুব্বররা তাদের বাবার রেখে যাওয়া বসতঘরের ৫০ হাজার টাকা মূল্য নির্ধারণ করে মোহাম্মদ আলীকে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে দিতে মস্তুফার উপর ধার্য করা হয়। মোহাম্মদ আলী মাতুব্বরদের ওই রায় মানতে অস্বীকার করে দুই ভাই এক সাথে থেকে যে ৫০ শতক জমি কিনেছে তার হিস্যা দবি করেন।
এর কিছুদিন পর আবারও মস্তুফার বিরুদ্ধে সালিশ ডাকার আয়োজন করলে মস্তুফা ও তার অন্য তিন বড় ভাই তারা মিয়া, সোবান, সরুজ আলী এবং তাদের সন্তানরা মোহাম্মদ আলীকে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে। প্রাণ বাঁচাতে মোহাম্মদ আলী বাড়ি থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দৌড়ে গিয়ে একটি পুকুরে পড়ে গেলে ওখানেই তাকে কুপানো হয়।
মোহাম্মদ আলী মারা গেছে ভেবে আক্রমণকারীরা চলে এলে এলাকাবাসী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আক্রমণকারীদের দায়ের কোপে বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলী বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মোহাম্মদ আলীর। সেই সাথে ডান হাতের তরজুনী, মধ্যমা ও অনামিকা আঙুল তিনটি ঝুলে পড়ে। সারা শরীরে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়।
ওই সময় ছোট ছেলের পাশে দাঁড়ান মা সামেরন্নেছা। তার নিজ নামে ক্রয় করা ২০ শতক জমি বিক্রি করে ছোট ছেলের চিকিৎসা করান। ওই ঘটনায় বড় ভাইদের আসামি করে মোহাম্মদ আলী বাদি হয়ে থানায় মামলা করেন। মামলায় সাজা হওয়ার ভয়ে মায়ের পায়ে পড়ে ক্ষমা চান বড় চার ছেলে তারা মিয়া, সোবান, সরুজ আলী ও মস্তুফা।
বিষযটি মীমাংসা করতে বড় ছেলেদের অনুরোধে স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তির প্রাপ্য হিস্যা লিখে দেন ছোট ছেলে মোহাম্মদ আলীকে। দুই বছর ধরে ওই জমিটুকুও এখন বেদখলে রেখেছেন মোস্তাফা। ছোট ছেলে মোহাম্মদ আলী অন্যের জমি বর্গা চাষ করে আর দিনমজুরের কাজ করে মা’কে নিয়ে অতিকষ্টে দিন যাপন করছেন।
মা সামেরন্নেছা বলেন, থানায় মামলা করলে ছেলেরা তার ছোট ছেলে ও তাকে মেরে ফেলবে বলে হুমকী দিয়েছে। এর আগেও ছোট ছেলেকে মেরে ফেলতে চেয়েছে। স্বামীর দেয়া হিস্যাটুকু ছোট ছেলেকে লিখে দিলেও ভয়ে জমিতে চাষ করতে যেতে পারে না। জমির পাশে গেলেই মোহাম্মদ আলীকে মারতে আসে। অনেক সময় খাই, অনেক সময় উপোস থাকি। বড় ছেলেরা জিজ্ঞাসাও করে না। আমি এই বিচার আল্লাহর কাছে রাখছি।
মোহাম্মদ আলী বলেন, আমাকে একবার ওরা মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। এখনো মেরে ফেলার হুমকী দিয়ে যাচ্ছে। জমিতে গেলে মারধর করে। আমি আমার মাকে নিয়ে প্রাণনাশের আশঙ্কা করছি। ভয়ে থানায় মামলা করতে যাই না। মামলার কথা শুনলে একেবারে জানে মেরে ফেলবে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত বড় ভাই মোস্তফা বলেন, মা ক্ষেতে ক্ষেতে দাগে দাগে হিস্যা পান। কোন এক দাগে লিখে দিলে তো হবে না। আর মা যে জমিটুকু লিখে দিয়েছেন সেটা রাস্তার পাশে। এটার মূল্য বেশি। তাই জায়গা বেদখল দিয়েছি। আর প্রাণনাশের হুমকী সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। মা মোহাম্মদ আলীর পক্ষ নিয়েছে তাই মিথ্যা কথা বলছেন।
মগটুলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বদরুজ্জামান মামুন বলেন, ‘ঘটনাটি সত্য। বড় ছেলেরা দাঙ্গাবাজ। ছোট ছেলে মোহাম্মদ আলীর সারা শরীর কুপিয়ে পঙ্গু করে দিয়েছে। এরা এতোই ভয়ঙ্কর যে আমিও ওদের কাছ থেকে নিরাপদ নই। যে কোনো সময় আমাকেও ওরা কোপাতে পারে। মোহাম্মদ আলী আইনগত সহায়তা চাইলে আমি তাকে সহযোগিতা করবো।’