মধ্য প্রদেশের একজন ঊর্ধ্বতন মুসলমান কর্মকর্তা সরকারের কাছে তার নাম পরিবর্তনের অনুমতি চেয়েছেন। কংগ্রেসশাসিত ওই রাজ্যে ডেপুটি সেক্রেটারি র্যাংকের অফিসার নিয়াজ আহমদ খান এক টুইটের মাধ্যমে নাম পরিবর্তনের কথা বলেছেন। তার বক্তব্য, ‘নতুন নাম আমাকে উত্তেজনাপূর্ণ গণপিটুনি থেকে রক্ষা করবে। যদি আমার কাছে কোনো টুপি বা কোর্তা না থাকে, যদি আমার দাড়ি না থাকে, তাহলে পরিবর্তিত নাম বলে গণপিটুনির হাত থেকে খুব সহজে বেরিয়ে আসতে পারব। অথচ আমার ভাই চিরাচরিত ঐতিহ্যের পোশাক পরে আছে, মুখে দাড়িও আছে। সে সবচেয়ে ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।’
নিয়াজ খানের এ বক্তব্য মূলত পুরো ভারতের মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া ভয়-ভীতি ও হতাশার পরিস্থিতি চিৎকার করে জানান দিচ্ছে। অথচ তার ভীতি বর্তমান পরিস্থিতি থেকে সৃষ্ট হয়নি, বরং এক যুগ যাবৎ মুসলমান হওয়ার ‘শাস্তি’ ভুগছেন তিনি। তার কাহিনীর অপর অংশ আমরা পরে বর্ণনা করব। এর আগে আসুন, আমরা ওই পরিস্থিতির পর্যালোচনা করি, গত পাঁচ বছর ধরে ভারতের মুসলমানেরা যার মুখোমুখি। এ পরিস্থিতি এতটাই কঠিন ও বেদনাদায়ক যে, তা পরিপূর্ণরূপে ভাষায় প্রকাশ করাও বেশ কষ্টসাধ্য। ভয়ের ধারা ক্রমাগত বাড়ছে। মুসলমানেরা নিঃসঙ্গ অনুভব করছেন। স্বাধীনতার পর মুসলমানদের ওপর এমন কঠিন মুহূর্ত প্রথমবারের মতো এসেছে। তারা বুঝে উঠতে পারছেন না, তাদের কোন অপরাধে শাস্তি দেয়া হচ্ছে? আর কোথায় গিয়ে এ শাস্তির পরিসমাপ্তি ঘটবে?
অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণ করতে গিয়ে মুসলমানদের আস্থা অর্জন এবং তাদের ভেতর ছড়িয়ে পড়া ভয় দূর করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু বাস্তবায়নের কোনো নমুনা এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। প্রধানমন্ত্রী মোদি তার প্রথম মেয়াদের মুখরিত স্লোগান ‘সবার সাথে সবাইকে সাথে নিয়ে’-এর পাশাপাশি ‘সবার আস্থা’ অর্জনের কথা মুসলমানদের আশ্বস্ত করার জন্য বলেছিলেন। অথচ এর পরে ভারতজুড়ে গণপিটুনির নামে মুসলমানদের সাথে যা কিছু ঘটেছে তা সারা বিশ্ব খোলা চোখে দেখেছে এবং এর আওয়াজ জাতিসঙ্ঘ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এ কথা সবাই জানেন, ভারতজুড়ে মুসলমানদের গণপিটুনির লক্ষ্য বানানোর ঘটনা বেড়েই চলেছে। প্রতিদিনই কোথাও-না-কোথাও থেকে এ ধরনের ভয়ঙ্কর খবর আসছে এবং মুসলমানেরা আরো আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছেন।
তাদের ভীতসন্ত্রস্ত করতে এবং ক্রমাগত ভীতিকর পরিবেশের মধ্যে রাখার চক্রান্তের পেছনে কোন হুকুমদাতা রয়েছে, তা কারো জানা নেই। ভারতের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে ক্রমাগত ভীতি ও সন্ত্রাসের সম্প্রদায়ের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখে ভারতের কী এমন কল্যাণ করা হচ্ছে? এটা মুসলমানদের কোণঠাসা এবং তাদের সহায়হীন করার পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র নয় তো? মুসলমানেরা গণপিটুনির বর্বরতার ধারাকে যথাসাধ্য প্রতিহত করতে চেষ্টা করছেন এবং তাদের দিকে ক্রমাগত সরকারকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন, কিন্তু তাদের আওয়াজ ঢোলের আসরে অসহায় তোতা পাখির আওয়াজে রূপ নিচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। প্রতিবাদকারী মুসলমানদের শিক্ষা দেয়া এবং তাদের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার চেষ্টাও চলছে। ঝাড়খন্ডে তাবরেজ আনসারির বর্বরোচিত হত্যার বিরুদ্ধে মুসলমানদের উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভ থামার কোনো নামগন্ধ নেই। তারা সর্বাত্মক প্রতিবাদ করছেন। স্থানীয় প্রশাসন তাদের সান্ত্বনা দেয়ার পরিবর্তে ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে।
উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও ঝাড়খন্ডের কয়েকটি শহরে সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে প্রতিবাদী মুসলমানদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়েছে। ইউপির মিরাট ও আগ্রায় গণপিটুনির বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারী মুসলমানদের নামে ‘বিশৃঙ্খলা ছড়ানো ও নৈরাজ্য সৃষ্টি’র মামলা দায়ের করা হয়েছে, যাতে তারা বঞ্চিত হয় গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে। মিরাটে প্রতিবাদের আহ্বানকারী বদর আলি নামের এক সমাজকর্মীর বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অধীনে শুধু আইনি ব্যবস্থা গ্রহণই করা হয়নি, বরং দরিদ্র ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য প্রতিষ্ঠিত তার নার্সিং হোমের ওপর বুলডোজারও চালানো হয়েছে। এটা মূলত মুসলমানদের দমিয়ে রাখা ও নিষ্পেষণ করার চেষ্টা বৈকি। প্রশ্ন হচ্ছে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিবাদ করা এবং অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অধিকার থেকে কেন মুসলমানদের বঞ্চিত করা হচ্ছে?
এ দেশে যেকোনো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর ন্যায় বিচারের দাবি করা প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। কিন্তু মুসলমানদের দুনিয়াকে এতটাই কঠিন করে দেয়া হয়েছে যে, তাদের সব অধিকার ছিনিয়ে নেয়া এবং তাদের শাস্তিযোগ্য বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ গণপিটুনির বিরুদ্ধে মুসলমানেরা যেখানেই বিক্ষোভ করেছেন, সেখানে পূর্ণমাত্রায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রয়েছে। কোথাও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সূত্রপাত ঘটেনি। তথাপি পুলিশ ও প্রশাসন তাদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কয়েকটি স্থানে মুসলমানদের ওপর লাঠি চার্জ করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ‘বিশৃঙ্খলা ছড়ানো’র অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও মুসলমানেরা ধৈর্যহারা হননি। তারা ভারতের সেকুলার গণতান্ত্রিক সংবিধান ও আদালতের ওপর আস্থা প্রকাশ করে যাচ্ছেন। মুসলমানদের জন্য এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কী হতে পারে, যে দেশের স্বাধীনতার জন্য তারা প্রাণ দিয়েছেন, যার উন্নয়নের জন্য নিজেদের রক্ত-ঘাম ঝরিয়েছেন, আজ সেখানে তাদের ধর্মীয় পরিচয় লুকাতে বাধ্য করা হচ্ছে।
তাদের গণপিটুনির শিকারে পরিণত হওয়ার ভীতি তাড়া করছে প্রতিটি মুহূর্ত। আমরা নিয়াজ আহমদ খানের দিকে ফিরে যাই। তিনি তার নাম পরিবর্তনের অনুমতি প্রার্থনা করার পর আরেকটি টুইটে লিখেছেন, ‘যেহেতু কোনো দফতরই আমাদের বাঁচানোর ক্ষমতা রাখে না, এ জন্য নাম পরিবর্তন করাটাই শ্রেয়।’ তিনি লিখেছেন, ‘আমার সম্প্রদায়ের বলিউড অভিনেতাদেরও তাদের ফিল্মের নিরাপত্তার জন্য নতুন নাম অনুসন্ধান শুরু করে দেয়া উচিত। এখন তো টপস্টারদের ফিল্মও ফ্লপ হওয়া শুরু হয়েছে। এর মর্ম তাদের অনুধাবন করা উচিত।’ নিয়াজের এ ব্যথা এমন ক্রমাগত কষ্ট-যাতনার সাক্ষ্য, যা তিনি গত কয়েক বছর ধরে বহন করছেন।
একজন মুসলমান কর্মকর্তা হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তার সমস্যা আরো বেড়ে গেছে। সূত্র মোতাবেক, নিয়াজ আহমদ গত ১৩ বছরে ২০ বার বদলি হয়েছেন। এর সবচেয়ে বড় কারণ, তিনি একজন ঈমানদার ও দায়িত্বসচেতন কর্মকর্তা। তিনি সরকারি চাকরি ও দুর্নীতির ওপর দু’টি গ্রন্থও রচনা করেছেন। বলা হয়, তিনি মধ্যপ্রদেশে একের পর এক নির্মমতার শিকার এ কারণে হয়েছেন যে, ওখানে দীর্ঘ সময় ধরে বিজেপির সরকার ছিল। তবে তিনি তার নাম পরিবর্তনের অনুমতি প্রার্থনা করেছেন কংগ্রেসের শাসনের সময়। বিস্ময়কর হলো, সেকুলারিজমের দোহাইদাতা কংগ্রেসের শাসনের সময়েও ওই সব কিছুই হচ্ছে, যা বিজেপির সময়ে হয়েছিল। এটা সেই মধ্যপ্রদেশ, যেখানে গত জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে গরু চোরাচালানের অভিযোগে ২৫ ব্যক্তিকে রশি দিয়ে বেঁধে রাস্তায় ছেঁচড়ানো হয়েছে।
এরপর তাদেরকে ‘মুরগি বানিয়ে’ শাস্তি দেয়া হয়। ওই মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতা গ্রহণের পর মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথের নেতৃত্বে গোহত্যার অভিযোগে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এনএসএ’র (ঘধঃরড়হধষ ঝবপঁৎরঃু অফারংড়ৎ) আওতায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো। মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছে, ‘সেকুলা’র পার্টির রাজ্যেও মুসলমানদের সাথে সে আচরণই করা হচ্ছে, যা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর রাজ্যে করা হচ্ছে। সেকুলার সরকারগুলোও মুসলমানদের গণপিটুনি থেকে রক্ষার জন্য কিছুই করছে না। গণপিটুনির সর্বপ্রথম ঘটনা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তরপ্রদেশের দাদরি অঞ্চলে ওই সময় ঘটেছিল, যখন ওখানে অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী পার্টি ক্ষমতায় ছিল। এ অখিলেশ সাধারণ নির্বাচনের আগে মায়াবতীকে বলেছিলেন, তিনি যেন অধিকসংখ্যক মুসলমানদের টিকিট না দেন।
কেননা, এমনটি করা হলে মেরুকরণ হয়ে যাবে। আজ অখিলেশ যাদবের দুর্ভাগ্য হলো, খোদ তার ভাই তাকে ‘আছাড় মেরে ফেলে দিয়েছে’। আর লোকসভার জন্য তার পাঁচজন সদস্য মুসলিম ভোটের ওপর ভিত্তি করে নির্বাচিত হয়েছেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন তিনজন মুসলমানও। এ অবস্থায় সেকুলার রাজনৈতিক দলগুলো যখন মুসলমানদের গণপিটুনি থেকে রক্ষা করতে কিছুই করছে না, তখন সব দায়িত্ব মুসলমান ও তাদের নেতাদের ওপর বর্তায়। এখন দেখার পালা, মুসলমান নেতারা এ পরিস্থিতিতে কোন ধরনের কৌশল অবলম্বন করবেন।
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দুটাইমস, ১৪ জুলাই সংখ্যা থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট