মোবাইল আসক্তির ভয়াবহতা

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে প্রযুক্তিগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে; এর মধ্যে স্মার্টফোন অন্যতম। এটি যেমন দরকারি, তেমনি এর প্রতি আসক্তি যে কাউকে বিপদে ফেলতে পারে। এদিকে কম্পিউটার, টিভি ও মোবাইল ট্যাব শিশুদের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিচ্ছে। দুনিয়াজুড়ে লাখ লাখ শিশু ভুগছে দৃষ্টিশক্তির সমস্যায়। বাংলাদেশেও এটি আগ্রাসী থাবা বিস্তার করছে। ক্ষীণদৃষ্টিকে একসময় ভাবা হতো প্রবীণদের সমস্যা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কর্মক্ষমতাও হারায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। ফলে বয়স বাড়লে অন্তত চল্লিশের ওপর গেলে অনেকেই আক্রান্ত হন ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যায়। কম বয়সীদের ক্ষেত্রে ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা যে ছিল না; এটি হলপ করে বলা যাবে না। তবে সে সংখ্যা ছিল নগণ্য এবং এর কারণ ছিল প্রধানত অপুষ্টি।

কালের বিবর্তনে দেশে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা কমছে। কিন্তু ভয়াবহভাবে বাড়ছে ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা। যে সমস্যার পেছনে অপুষ্টি নয় বরং দায়ী তথ্যপ্রযুক্তি-আসক্তি। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল ফোন, টেলিভিশনে আসক্তি শিশুর দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিচ্ছে এমন তথ্যই জানিয়েছেন চোখের চিকিৎসায় দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকেরা। তারা শিশুদের চোখের সমস্যার তিনটি কারণের কথা বলেছেন। এর মধ্যে কোনো কোনো শিশু চোখে সমস্যা নিয়েই জন্মায়। ভিটামিন ‘এ’র অভাবে শিশু রাতকানা রোগে ভুগতে পারে, এমনকি অন্ধও হয়ে যেতে পারে।

তৃতীয়ত, স্ক্রিনের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে শিশুরা চশমা ছাড়া দূরের জিনিস দেখতে পায় না। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে মাসে গড়ে সাড়ে তিন হাজার শিশু আসে। এর ৭০ শতাংশ দূরের জিনিস ভালো দেখতে পায় না। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর তথ্যও অভিন্ন। ডাক্তারি ভাষায় রোগটিকে বলা হয় ‘মাইয়োপিয়া’ বা ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা। একই সাথে এ রোগকে বলা হচ্ছে ‘কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম’।

জাতিসঙ্ঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, প্রতিদিন ১ লাখ ৭৫ হাজার শিশু নতুনভাবে ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হচ্ছে। কম্পিউটার, টিভি ও মোবাইল ফোন আমাদের যাপিত জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে জীবনের সব ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আমাদের শিশুরাও যুক্ত হচ্ছে কম্পিউটার, টিভি, মোবাইল ট্যাবের সাথে। কিন্তু অতি আসক্তির কারণে তাদের একটি বড় অংশ সর্বনাশের শিকারও হচ্ছে। শুধু দৃষ্টিশক্তির সমস্যা নয়, নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যারও শিকার হচ্ছে তারা। এ বিপজ্জনক ধারা থেকে শিশুদের রক্ষায় বাবা-মাকে সতর্ক হতে হবে। শিশুরা যাতে কম্পিউটার বা মোবাইল-আসক্তি নামের সর্বনাশের দিকে পা না বাড়াতে পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

বর্তমানে আমরা অনেকেই মুঠোফোন বা মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছি। দেখা যায়, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২২ ঘণ্টাই এ যন্ত্র নিয়ে পড়ে থাকি। যার কারণে পরিবার-আত্মীয়স্বজন থেকে একটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। আমাদের একটি নতুন জগত তৈরি হয়ে হচ্ছে, যা আমাদের শরীর-মনকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অনেক চেষ্টা করেও মোবাইল ফোন আসক্তি থেকে বের হতে পারি না।

মোবাইল আসক্তি কমাতে যুতসই করণীয়- নিজের মনকে স্থির করতে হবে এবং বলতে হবে ‘আমি আমার মোবাইল ফোনটি প্রতিদিন এক ঘণ্টার বেশি ব্যবহার করব না।’ কোনোভাবেই এ চিন্তার বাইরে যাওয়া যাবে না। খুব বেশি জরুরি প্রয়োজন না হলে মোবাইল ফোনটি একেবারে কাছে রাখার দরকার নেই। শুয়ে-বসে হাত বাড়ালেই ফোনটি পাবেন, আসক্তি দূর করতে চাইলে এমন নৈকট্য পরিহার করা অতীব জরুরি।

প্রিয় ফোনটি দূরে রেখে এবার প্রিয় বইটি কাছে নেয়া যেতে পারে। হাত বাড়ালেই হয়তো ফোনটি পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু বইটি তো রয়েছে! এভাবেই অভ্যাস ভাঙার চেয়ে বেশি কাজে লাগবে নতুন অভ্যাস গড়ে তোলা। হতে পারে বই আপনার পছন্দ নয়। কিন্তু এমন অনেক জিনিস আছে পছন্দের, মোবাইল ফোনটি দূরে সরিয়ে এবার সেসবের সাথে সময় কাটান। আমরা চাইলেও মোবাইল থেকে দূরে থাকতে পারি না। কিন্তু নিজের সুস্থতার জন্য হলেও মোবাইলে আসক্ত হওয়া থেকে দূরে থাকার চেষ্টার বিকল্প নেই।

লেখক : সহসভাপতি, এফবিসিসিআই

Share this post

scroll to top