বাংলাদেশের সাবেক সামরিক শাসক ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর যেকোন বিশৃঙ্খলায় তার দলে ভাঙন দেখা দিতে পারে – এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্ব’ থাকে। আর দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ‘গণতন্ত্রের অভাব’ রয়েছে। এই পটভূমিতে জেনারেল এরশাদের অনুপস্থিতি জাতীয় পার্টির ভবিষ্যতকে কোন দিকে নিয়ে যাবে, এমন প্রশ্ন করা হয়েছিলো রাজনৈতিক বিশ্লেষক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদকে।
বিবিসিকে তিনি বলেনে, ‘জাতীয় পার্টি কোন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়নি। এটি ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।’
‘জাতীয় পার্টি সুবিধাবাদীর রাজনীতি করেছে। যার কারণে এক সময় ক্ষমতা ভোগ করেছে, এক সময় ছিটকে পড়েছে ক্ষমতার বলয় থেকে। আবার সমন্বয় করে ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে ঢুকেছিলো। কিন্তু এতো সবকিছুই এরশাদকে কেন্দ্র করে ছিল।’
আহমেদ বলেন, ‘এখানে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব রয়েছে। দলে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে একটি ধারা রয়েছে । আরেকটি ধারা জিএম কাদেরকে কেন্দ্র করে। এই ধারাই কিন্তু এক সময় ভেঙে যেতে পারে।’
‘অথবা দুটি ধারার একটি আওয়ামী লীগের সাথে মিশে যাবে, আরেকটি এ্যান্টি-আওয়ামীলীগ ফোরামে বা বিএনপি ফোরামের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে।’
পারসোনালিটি কাল্ট বা ব্যক্তি জনপ্রিয়তা এদেশের রাজনীতির একটা বড় অংশ, যা জেনারেল এরশাদের মধ্যেও ছিল। কিন্তু এধরণের আরো অনেক দল যেমন, মওলানা ভাসানী কিংবা এ কে ফজলুল হকের মতো ক্ষমতাশালী ও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের মৃত্যুর পর তাদের দলগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এরশাদের জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে কি-না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘খুব সম্ভাবনা রয়েছে এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণ একথাই বলে।’
তিনি বলেন, ‘এই দলের কোন জনভিত্তি নেই, আদর্শিক ভিত্তি নেই, কোন ভবিষ্যৎ কমিটমেন্ট নেই। একারণে মওলানা ভাসানী ও শেরে বাংলার দলের মতো জাতীয় পার্টিও বিলুপ্ত হতে পারে বলে আমার ধারণা। ’
আওয়ামীলীগ, বিএনপি কিংবা বামদলগুলো সুস্পষ্ট রাজনৈতিক মতবাদের ভিত্তিতে কাজ করে। এমন সুসংগঠিত দলগুলোর রাজনীতিতে দলগত আদর্শিক ভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও জাতীয় পার্টি কিভাবে এতো দিন টিকে ছিলো এমন প্রশ্নও করা হয় আহমেদকে।
তিনি বলেন, ‘টিকে ছিলো ক্ষমতার রসায়নে একটা জায়গা ছিলো বলে। কারণ যেকোন স্বৈরাচারের পতনের পরে একজন স্বৈরাচারী শাসক রাজনীতিতে টিকে থাকে না। কিন্তু এরশাদ টিকে ছিলেন শুধু তার রংপুর রাজনীতিকে ভিত্তি করে।’
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে পতনের পর, জেলখানায় থেকে তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়ে রংপুরের ৫টি আসনে জয় লাভ করেছিলেন এরশাদ।’
‘এরপর থেকে রংপুরকে ভিত্তি করে একটি আঞ্চলিক দল হিসেবে পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসিতে ১৫-২০ আসন পেলে একটা বার্গেনিং পজিশন থাকে। এরশাদ সেটাকে কাজে লাগিয়েছেন।’
১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখল করে প্রায় নয় বছর দেশ শাসনের পর ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ পদত্যাগ করেন। কিন্তু তারপরও জাতীয় পার্টি বিস্ময়করভাবে ক্ষমতার রাজনীতিতে ফিরে আসেন।
ক্ষমতা হারানোর পর থেকে এরশাদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনে আওয়ামীলীগ বা বিএনপির ভূমিকাই বেশি ছিল বলে উল্লেখ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক আহমেদ। তিনি বলেন, এসব দলের কারণেই রাজনীতিতে টিকে গেছেন জেনারেল এরশাদ।
‘এরশাদ সারভাইভ করতে [টিকে থাকতে] পারতো না যদি এরা এরশাদকে নিয়ে প্লে [খেলা] করতে না চাইতো। আওয়ামীলীগও করেছে বিএনপিও করেছে,’ তিনি বলেন।
‘পার্লামেন্টোরি ডেমোক্রেসির মধ্যে অঞ্চল ভিত্তিক একটা প্রভাব ছিল। একটা রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ছিল। এটাকে তারা ব্যবহার করতে চেয়েছে।’
‘এটাকে ব্যবহার করতে গিয়ে এরশাদকে এমন অবস্থানে নিয়ে গেছে যে, এরশাদ খুব দুর্বল অবস্থানে থেকেও সবলভাবে ক্ষমতার রাজনীতিতে দর কষাকষি করতে পেরেছে। এর কারণেই তিনি ১৯৯৬ থেকে ক্ষমতার বলয়ের বাইরে আর পরে যাননি,’ তিনি বলেন। সূত্র : বিবিসি