মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অফুরন্ত রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের অমিয় বারতা নিয়ে শুভাগমন করল হিজরি ১৪৪০ সালের মাহে রমজানুল মোবারক। আজ পবিত্র রমজানের প্রথম দিন। উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য প্রতি বছর এই পবিত্র মাস এক শুভ উপলক্ষ। তাদের জন্য অপরিসীম প্রতিদান লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদত ও নেক আমলের মওসুম রমজান মাস। তবে এ মাসের প্রধান ইবাদত সিয়াম বা রোজা।
সিয়াম শব্দের আভিধানিক অর্থ সংযমী হওয়া, নিবৃত্ত থাকা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহকারে পানাহার ও কামাচার থেকে নিবৃত্ত থাকার নাম সিয়াম। রমজানের পুরো মাস সিয়াম পালন করা ইসলামের পাঁচটি মৌলিক বিষয়ের একটি।
আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরত করে যাওয়ার দ্বিতীয় বছরে রমজানের সিয়াম পালনের বিধান নিয়ে নাজিল হয় কুরআন মজিদের সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতটি। ঘোষণা করা হয়, হে মুমিনরা, তোমাদের প্রতি সিয়াম পালন আবশ্যিক করা হলো যেমন তা আবশ্যিক করা হয়েছিল তোমাদের আগে যারা ছিল তাদের প্রতি, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।
এ আয়াত নাজিল হওয়ার পর প্রথম রমজান আগমনের আগে আল্লাহর নবী তার সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশে এক নাতিদীর্ঘ ভাষণ দেন। হাদিস শাস্ত্রের অন্যতম প্রসিদ্ধ মনীষী ইমাম বায়হাকিসহ বেশ কয়েকজন মুহাদ্দিস তাদের গ্রন্থে এটি সঙ্কলন করেছেন। এতে তিনি রমজানের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও করণীয় সম্পর্কে উম্মতকে অবহিত করেন।
হজরত সালমান ফারসি রাজিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, শাবান মাসের শেষ ভাগে একদিন রাসূলুল্লাহ সা: আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। বললেন, হে লোকেরা, তোমাদের ওপর এসে পড়েছে এক মহান মাস, বরকতময় মাস। এ মাসে একটি রাত রয়েছে যা এক হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তায়ালা এ মাসের সিয়াম ফরজ ও (ইবাদতের উদ্দেশ্যে) রাতে জেগে থাকা ঐচ্ছিক করেছেন। এতে যে ব্যক্তি কোনো নেক কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করবে, তার জন্য থাকবে অন্য মাসে একটি ফরজ আদায়ের সমান প্রতিদান। আর যে ব্যক্তি এতে একটি ফরজ আদায় করবে, তার জন্য থাকবে অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায়ের সমান প্রতিদান। যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার জন্য রয়েছে পাপমোচন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং রোজাদারের মতোই তাকে প্রতিদান দেয়া হবে। কিন্তু রোজাদারের প্রতিদান কমানো হবে না।
প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল, রোজাদারকে ইফতার করানোর মতো সামর্থ্য আমাদের প্রত্যেকের নেই। তিনি বললেন, যে কেউ কোনো রোজাদারকে একটু দুধ, একটি খেজুর কিংবা একটু পানীয় দিয়ে ইফতার করাবে, তাকেই আল্লাহ তায়ালা এ প্রতিদান দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে তৃপ্ত করে আহার করাবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে হাউজে কাওছার থেকে পানি পান করাবেন। এ মাসের প্রথম ভাগে রহমত, মধ্যভাগে মাগফিরাত ও শেষভাগে রয়েছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি। এটি ধৈর্যের মাস। আর ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত। এটি সমবেদনার মাস। এ মাসে মুমিনের রিজিক বাড়িয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি তার অধীনস্থের কাজের ভার লাঘব করবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন।
আজ থেকেই প্রস্তুতি নেয়া উচিত যাতে এ পবিত্র মাসের কল্যাণ যথাসম্ভব বেশি অর্জন করা যায়। এ জন্য প্রথমত দোয়া করা প্রয়োজন যেন আল্লাহ তায়ালা এ মাসের শেষ পর্যন্ত হায়াত দান করেন।
দ্বিতীয়ত, রমজানের স্বার্থেই শরীরের যত্ন নেয়া মুমিন বান্দাদের অন্যতম কর্তব্য। পুরো এক মাস দিনের বেলায় পানাহার বর্জন করতে হবে। এ বছর আমাদের এই প্রতিদিনের সংযমের মেয়াদ হবে প্রায় সাড়ে চৌদ্দ ঘণ্টা। লাগাতার এই সাধনায় যেন ব্যত্যয় না ঘটে, সে জন্য আল্লাহর কাছে যেমন দোয়া করতে হবে, তেমনি শরীরটাকেও প্রস্তুত রাখতে হবে। এমন কোনো কাজ করা উচিত হবে না, যাতে শরীরে অতিরিক্ত ক্লান্তি বা অবসাদ আসে এবং রমজানের সিয়াম পালনে বেশি কষ্ট অনুভূত হয়। তা ছাড়া পাপাচার বর্জন করতে হবে।
অত্যন্ত ফজিলতের মাসে রোজা পালনও প্রত্যাশিত সুফল বয়ে আনবে না যদি পাপাচার বর্জন না করা হয়। পাপাচার বর্জনের সাথেই আসে তওবা ইস্তেগফারের প্রসঙ্গ। পাপরাশি থেকে মুক্ত হয়ে পূত পবিত্র অন্তরে মহান রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্য অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটিতে আত্মনিয়োগ করা মুমিন বান্দাদের কর্তব্য।
রহমত-মাগফিরাত-নাজাতের মাসে আরেকটি বিষয়ের প্রতি আমাদের মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। যে মাসটিকে অধিক থেকে অধিকতর সওয়াব লাভের সুযোগ হিসেবে আমরা লাভ করি, সেই মাহে রমজানকে কেন্দ্র করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফাখোরিতে লিপ্ত হন, যা খুবই নিন্দনীয়।
সার্বিকভাবে রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষার লক্ষ্যে ইবাদত-বন্দেগিকে নির্বিঘ্ন করতে সব ব্যবসায়ীর জন্যই এ মাসের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মর্যাদা উপলব্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং তাঁর প্রতিদান লাভের আশায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না করে বরং কমিয়ে আনা এবং বাজার স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি খাদ্যে ভেজাল না মেশানোই হবে সব ব্যবসায়ী ভাইয়ের নৈতিক দায়িত্ব।