পরীক্ষা বন্ধ রেখে স্কুলে এমপিকে অভ্যর্থনা

নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার একটি স্কুলে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বন্ধ রেখে স্থানীয় জাতীয় পার্টির (এরশাদ) এমপি সেলিম ওসমানের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য বাধ্য করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই ঘটনায় ৪৫ মিনিট পরীক্ষা বন্ধ ছিল। এদিকে শহরের অপর একটি স্কুলে পরীক্ষা শেষ হলেও সেলিম ওসমানের অনুষ্ঠানের জন্য চার ঘণ্টা আটকে রাখার অভিযোগ করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা।

শনিবার সকালে উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে পরীক্ষা বন্ধ থাকে ও বিকেলে শহরের মর্গ্যান গালর্স স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষার্থীদের আটকে রাখার ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার সকাল ১০টায় কলাগাছিয়া ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হয়। বেলা ১১টায় স্কুলে খবর আসে যে স্কুলের উন্নয়ন কাজের জন্য অনুদানের চেক দিতে নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর ও বন্দর) আসনের এমপি সেলিম ওসমান স্কুলে আসছেন। সেজন্য ১১টা ৫ মিনিট থেকে পরীক্ষার কার্যক্রম বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের দুই লাইনে সারিবদ্ধভাবে স্কুলের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়।

এরপর সোয়া ১১টায় স্ত্রী নাসরিন ওসমানসহ আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের নিয়ে স্কুলে আসেন এমপি সেলিম ওসমান। তিনি প্রধান শিক্ষকের কক্ষের সামনে বারান্দায় শিক্ষকসহ স্কুলের পরিচালনা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে সেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হাতে অনুদানের ২৫ লাখ টাকার চেক সহধর্মিণীকে নিয়ে তুলে দেন সেলিম ওসমান।

এসময় সেলিম ওসমান ও নাসরিন ওসমান শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ২০ মিনিট বক্তব্য রাখেন। শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে পড়ালেখা করার পরামর্শের পাশাপাশি সকল সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন তিনি এবং সেলিম ওসমানের জন্য দোয়া করতে বলেন।

স্কুলের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্র বলেন, শনিবার আমাদের সমাজ পরীক্ষা চলছিল। এর মধ্যে স্যারেরা ঘোষণা দেন এমপি সেলিম ওসমান আসছেন। উনাকে অভ্যর্থনা জানাতে স্কুলের গেটে দাঁড়াতে হবে। এজন্য পরীক্ষা বন্ধ করে সবাইকে গেটে যেতে বলা হয়। আমরা সেখানে দাঁড়ানোর ১০মিনিট পর এমপি সাহেব আসেন। এর আধ ঘণ্টা পর আবারো পরীক্ষা শুরু হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বলেন, স্কুলের উন্নয়নে চেক প্রদান উপলক্ষে শিক্ষার্থীদের ৩০ থেকে ৪০ মিনিট পরীক্ষা বন্ধ রাখতে হবে এটা কেমন নিয়ম। পরীক্ষার মধ্যে থেকে বাচ্চাদের উঠিয়ে এনে বাইরে গেটে দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে এমপিকে স্বাগত জানানোর জন্য। একে-তো সময় নষ্ট করেছে তার ওপর তাদের সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়নি।

স্কুলের শিক্ষক রাকিব মিয়া বলেন, সকাল ১০টা থেকে পরীক্ষা শুরু হয়। বেলা ১টায় সব পরীক্ষা শেষ হয়। এর মধ্যে এমপি সাহেব এসেছিলেন সেজন্য ‘কিছুটা সময়’ পরীক্ষা বন্ধ ছিল। পরে আবার পরীক্ষা শুরু হয়।

এ বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ৬ষ্ঠ থেকে ১০ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা ছিল। তবে এটা ‘গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা’ ছিল না। ১০মিনিট পর আবারও যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, কোনো পরীক্ষা বন্ধ ছিল না। এই কথা বলেই ফোন বিচ্ছিন্ন করে বন্ধ করে দেন তিনি।

এদিকে নারায়ণগঞ্জ শহরের মর্গ্যান গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণ ও নবনির্মিত ‘বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব’ ভবন উদ্বোধন উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন এমপি সেলিম ওসমান আর বিশেষ অতিথি জেলা প্রশাসক রাব্বী মিয়া।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বলেন, সকাল ১০টা থেকে মর্গ্যান গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা শেষ হয় দুপুর ১টায়। কিন্তু সেলিম ওসমান স্কুলের অনুষ্ঠানে আসবেন তাই শিক্ষার্থীরা যেন বের হয়ে না যেতে পারে তাই স্কুলের ফটক আটকে রাখা হয়। দুপুর ২টায় অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বিকেল সাড়ে ৩টায় স্কুলে আসেন এমপি সেলিম ওসমান ও জেলা প্রশাসক রাব্বী মিয়া। দুপুরে খাবার খেয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয় বেলা ৩টা ৫০মিনিটে। আর শেষ হতে হতে বেজে যায় ৫টা।

অভিভাবকেরা অভিযোগ করেন, আগামীকাল ( আজ রোববার) গণিত পরীক্ষা। কিন্তু বিকেল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের স্কুলের আটকে রাখা হয়েছে। বার বার গেট খোলার কথা বললেও দারোয়ান থেকে শিক্ষক কেউ কর্ণপাত করেননি। এতে পরীক্ষা খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ মর্গ্যান গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ অশোক তরু বলেন, দুপুরে শিক্ষার্থীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা স্কুলে খাবার খেয়েছে। তবে এমপি সাহেব আসতে দেরি হওয়ায় শিক্ষার্থীদের কিছুক্ষণ আটকে রাখতে হয়। কারণ সামনে রোজার বন্ধ ও এমপি সাহেবের সময় পাওয়া যাচ্ছিল না। সে কারণেই বাধ্য হয়ে এখন অনুষ্ঠান করতে হয়েছে। তবে আমরা শিক্ষার্থীদের বলেছি পরীক্ষায় সমস্যা হলে আমরা বিষয়টি দেখব।

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ বলেন, কোনো অনুষ্ঠানের জন্য সরকারি পরীক্ষা বন্ধ থাকতে পারে না।

তবে সেলিম ওসমানের অনুষ্ঠানের জন্য পরীক্ষা বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের আটকে রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। প্রয়োজনে প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে এমপি সেলিম ওসমান বলেন, কলাগাছিয়া স্কুলে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ছিল না। সেটা তারা পরে নিয়ে নিবেন। আর মর্গ্যানে কোনো শিক্ষার্থীকে আটকে রাখা হয়নি। তারা নিজেদের ইচ্ছায় সেখানে ছিল।

তিনি আরো বলেন, আমি যেটুকু জানি বাইরে থেকে লোকজন প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন সেজন্য গেট বন্ধ করে রাখা হয়। এটা মেয়েদের স্কুল। নিরাপত্তার জন্য এটা করা হয়েছে। আর অভিভাবকেরা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কাউকে জোর করে আটকে রাখা হয়নি।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top