বিএনপির ছয়জন সংসদ সদস্য (এমপি) শপথের বিনিময়ে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হবে এমন গুঞ্জন বেশ জোরালো হচ্ছে। এমনকি খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হবে মর্মে গুঞ্জন আরো বাড়ছে। যদিও বিএনপি এ ধরনের গুঞ্জন শুরু থেকেই নাকচ করে আসছে। তবে গুঞ্জন যতই থাকুক দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না বিএনপির এমপিদের কেউই। তারা বলছেন, আগে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হোক। তারপর শপথ নেয়া বা সংসদে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। কারণ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবেই খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তিতে কোনো বাধা নেই। এ ক্ষেত্রে সরকারই একমাত্র বাধা। জামিন পেলেও নানা অজুহাতে খালেদা জিয়াকে বন্দী রাখা হচ্ছে। আর খালেদা জিয়াও প্যারোলে মুক্তিতে রাজি নন। এমনই পরিস্থিতিতে বিএনপির এমপিদের শপথ নেয়া বা না নেয়ার বিষয়টি বেশ আলোড়ন তৈরি করেছে। সংবিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচিত এমপিদের শপথ নেয়ার যে বিধান আছে এখন তা ঘনিয়ে এসেছে। আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বিএনপির ছয় এমপিকে শপথ নিতে হবে। অন্যথায় তাদের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে ৮ জন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে বিএনপি থেকে ছয়জন। তারা হলেন- ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে মো: জাহিদুর রহমান, বগুড়া-৪ আসনে মো: মোশাররফ হোসেন, বগুড়া-৬ আসনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে মো: আমিনুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে মো: হারুনুর রশিদ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে উকিল আব্দুস সাত্তার। এর মধ্যে মৌলভীবাজার-২ আসনে ঐক্যফ্রন্টের এমপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর এবং সিলেট-২ আসনের মোকাব্বির খান সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ গ্রহণের কারণে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও মোকাব্বির খানকে ইতোমধ্যে বহিষ্কার করেছে গণফোরাম।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, সরকার চায় বিএনপির এমপিরা শপথ নিয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করুক; কিন্তু বিএনপির এমপি এবং দলের সিনিয়র নেতারা বলছেন- গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় নির্বাচনে যেভাবে মহা ভোট ডাকাতি ও আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরা হয়েছে তা শুধু দেশবাসী নয় বিশ্ববাসীও দেখেছেন। মাত্র ছয়জন এমপি পাওয়ার মতো দল বিএনপি নয়।
এহেন পরিস্থিতিতে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে সংসদে যাওয়া আর খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে যারা ভাবছেন তারা ভুলে আছেন। শপথের বিনিময়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়েই মতানৈক্য রয়েছে। সম্প্রতি কয়েকজন নেতার কথাবার্তায় উঠে এসেছে যে সমঝোতার মাধ্যমে হলেও তারা খালেদা জিয়ার বন্দিদশা ঘুচাতে চান। এর পেছনে সরকারের কোনো মহলের যোগসূত্রও থাকতে পারে। অন্য দিকে বিএনপির তৃণমূল এমনকি শীর্ষপর্যায়ের বিশাল একটি পক্ষের মতে কোনো অবস্থাতেই শপথের বিনিময়ে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা ঠিক হবে না। কারণ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই খালেদা জিয়া মুক্তি পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া এখন পর্যন্ত প্যারোলে বা কোনো ধরনের সমঝোতায় মুক্তির ব্যাপারে আগ্রহী নন। তিনি আইনি প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মুক্ত হতে চান। সুতরাং ছয়জন এমপির শপথ না নেয়ার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
দলের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, গত রোববার পয়লা বৈশাখের দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও নজরুল ইসলাম খান। সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা তারা খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ও চিকিৎসার বিষয়ে কথা বলেন। প্যারোলে মুক্তি এবং বিএনপির এমপিরা সংসদে যোগ দেয়ার বিষয়টিও আলোচনায় আসে। তবে খালেদা জিয়া এসব ব্যাপারে ইতিবাচক কোনো ইঙ্গিত দেননি; বরং ভিন্নমত পোষণ করেছেন। দলের চেয়ারপারসনের সাথে দেখা শেষে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্যারোলে মুক্তির কথা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, চিকিৎসার জন্য প্যারোলের সিদ্ধান্ত খালেদা জিয়া দেননি। এ নিয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি।
বিএনপির শীর্ষ কয়েকজন নেতা জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কিছু বিষয়ে খুবই কঠোর। যে কারণে তিনি আপসহীন উপাধি পেয়েছেন। তিনি কখনোই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন না। দেশ ও জনগণের কল্যাণে সবসময় লড়াই সংগ্রাম করেছেন। অতীতে তিনি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখনো গণতন্ত্রের জন্য, দেশের মানুষের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার জন্য সংগ্রাম করতে গিয়েই তিনি মিথ্যা মামলায় জেলে বন্দী। ছেলে হারিয়েছেন, বাড়ি হারিয়েছেন। এখন জীবনের বর্তমান ধাপে এসে তিনি অন্যায়ের কাছে মাথানত করবেন বলে বিশ্বাস হয় না।
বিএনপির এমপিরা কী বলছেন : সংসদে শপথ নেয়ার গুঞ্জনকে নাকচ করে দিয়ে বিএনপি এমপিরা বলছেন- দলের সিদ্ধান্তের বাইরে তারা যাবেন না। ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে বিএনপির এমপি মো: জাহিদুর রহমান গতকাল বুধবার নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি চারবার সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবারই বিজয়ী হয়েছি। অনেক খরচও হয়েছে। এ জন্য আমার প্রতি এলাকার জনগণের সহানুভূতি একটু বেশি। তাদের দাবি- আমি সংসদে গিয়ে তাদের প্রতিনিধিত্ব করি। কিন্তু দলের হাইকমান্ড যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই আমরা মেনে নেবো। কেননা আমি মনে করি শপথের বিনিময়ে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি নয়, তার নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। তারপর শপথের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসন থেকে বিএনপির এমপি হয়েছেন মো: হারুন অর রশিদ। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, শপথ নিয়ে সংসদে যোগদানের ব্যাপারে দল কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। আমরা চাই আগে ৭৪ বছর বয়সী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হোক। কারণ তাকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলায় কারাগারে বন্দী রাখা হয়েছে। তাকে মুক্তি দিলেই আমরা শপথের বিষয়ে বিবেচনা করতে পারি। দেশনেত্রীর সিদ্ধান্তের বাইরে আমরা কিছুই করব না।
বগুড়া-৪ আসন থেকে বিএনপির এমপি মো: মোশাররফ হোসেন বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের জন্য, দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে সংগ্রাম করতে গিয়ে বাড়ি হারিয়েছেন, ছেলে হারিয়েছেন। আজকে তাকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কারাগারে মিথ্যা মামলায় আটক রাখা হয়েছে। সবার আগে তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। পরে শপথের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কারণ যে খালেদা জিয়ার কারণে, যে বিএনপির কারণে আমরা আজকে এমপি সেই দল ও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে আমরা কিছু করতে পারি না। আগামী প্রজন্মকে টেকসই গণতন্ত্র উপহার দিতে হলে খালেদা জিয়ার মুক্তি অত্যন্ত জরুরি। তারপর অন্য কিছু। আমি ব্যক্তিগতভাবে শপথ নেয়ার বিপক্ষে।