নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পুলিশের এক কর্মকর্তা ও দুই কনস্টেবলকে পেটানো ছাত্রলীগ নেতাদের আটক করেও ছেড়ে দিয়েছেন থানার ওসি আক্তার হোসেন।
উপজেলার গোপালদী পুলিশ তদন্তকেন্দ্রে ঢুকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ওই হামলা চালালেও ওসি বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, পুরো ঘটনাই ঘটেছে নজরুল ইসলাম বাবু কলেজে। সেখানে নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্ক হয়েছিল।
একই সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য সাংবাদিকদের অনুরোধ করে হামলার শিকার ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে উদ্দেশ করে অশ্লীল মন্তব্যও করেন ওসি আক্তার হোসেন।
হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতাদের নিজেদের লোক দাবি করে ওসি বলেন, ‘কালকে এমপি সাব আমেরিকা গেছে। সব নিজেরা নিজেরা। বিএনপি হইতো একটা কথা আছিলো, ব্যবস্থা নিতে পারতাম।’
অপরদিকে হামলার শিকার পুলিশের এটিএসআই মামুন দাবি করেন, তাকে ও অপর ২ পুলিশ সদস্যকে তদন্তকেন্দ্রে ঢুকেই মারধর করা হয়েছে এবং গুলি করে হত্যার হুমকি দেন ছাত্রলীগ নেতা সুজয়।
এদিকে পুলিশ সদস্যরা বেদম মারধরের শিকার হলেও হামলাকারীদের ছেড়ে দেয়ায় পুরো পুলিশ প্রশাসনে ব্যাপক ক্ষোভ বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।
এর আগেও গত ২৯ মার্চ একটি সাধারণ ডায়েরিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের নেতারা থানায় ঢুকেই অশ্লীল গালাগাল আর শাসিয়েছিল পুলিশ সদস্যদের।
ওই ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলেও ছাত্রলীগ নেতাদের ব্যাপারে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়নি পুলিশ।
স্থানীয়রা জানান, বুধবার সকাল ১১টার দিকে মাদকসেবন ও ইভটিজিংয়ের অপরাধে উপজেলার রামচন্দ্রদী গ্রামের জামালউদ্দিনের ছেলে দিদার ইসলামকে গোপালদী বাজার থেকে আটক করে পুলিশ। তার আটকের খবর জানতে পেরে গোপালদী পৌর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সুজয় সাহা আটককৃত দিদারকে ছাড়িয়ে আনতে তদন্তকেন্দ্রে যান। পুলিশ তাকে ছাড়তে অস্বীকৃতি জানালে সুজয় পুলিশকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।
এ সময় এটিএসআই মামুন তার প্রতিবাদ করলে ছাত্রলীগ নেতা সুজয় ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে মারধর শুরু করেন। সুজয় মোবাইলে তার সহযোগীদের তদন্তকেন্দ্রে এনে পুলিশের ওপর হামলা চালাতে থাকেন। একপর্যায়ে কনস্টেবল ইমরান ও বাশার এগিয়ে আসলে তাদের ওপরও হামলা চালানো হয়।
এ খবর আড়াইহাজার থানার ওসি আক্তার হোসেন জানতে পেরে অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে তদন্তকেন্দ্রে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে সুজয় ও দিদারকে আটক করে থানায় নিয়ে আসেন।
আহত পুলিশ কর্মকর্তা মামুন, কনস্টেবল আবুল বাশার ও ইমরানকে উদ্ধার করে আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়।
এ ব্যাপারে বুধবার দুপুরে প্রথমে সাংবাদিকদের আড়াইহাজার থানার ওসি আক্তার হোসেন জানান, পুরো ঘটনার জন্য মামলার প্রস্তুতি চলছে।
কিন্তু বিকালে আটককৃত ছাত্রলীগ নেতা সুজয় ও কর্মী দিদারকে ছেড়ে দেয়ার পরই ওসি আক্তার হোসেনের ভাষ্য বদলে যায়। দ্রুত আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে আহত এটিএসআই মামুন ও ভর্তি থাকা ২ কনস্টেবলকে সেখান থেকে নিয়ে আসা হয়। পুরো ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়লে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয় পুলিশ সদস্যদের মাঝে।
এ ব্যাপারে হামলার শিকার এটিএসআই মামুন যুগান্তরকে বলেন, ‘গোপালদী এলাকার আশপাশ থেকে ইভটিজিংয়ের অভিযোগ আসছিল অনেক দিন থেকেই। আমরা বুধবার সকালে দিদারকে আটক করে তদন্তকেন্দ্রে নিয়ে এসে তাকে তার অভিভাবকদের ফোন দিতে বলি । সে ছাত্রলীগ নেতা সুজয়কে ফোন করে তদন্ত কেন্দ্রে আসতে বলে। সুজয় এসেই ক্ষিপ্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে দিদারকে কে গ্রেফতার করেছে। আমি আটক করেছি বললে সে আমাকে তুইতোকারি করে বলে, তর এত বড় সাহস তুই তারে নিয়ে আসছোস। তুই হেরে চিনোস। আমি কাছে যাওয়ার পরপরই আমাকে ঘুষি দিয়ে ফেলে দেয়। ফাঁড়ি উড়িয়ে দেবে, গুলি করে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়। এরপর ২ কনস্টেবল এগিয়ে আসলে সুজয় ও তার সঙ্গে লোকজন আমাদের বেধড়ক পিটিয়ে আহত করে।’
আটককৃত ২ জনকে ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে মামুন বলেন, পুলিশের ওপর হামলার পর কেন তাদের ছেড়ে দেয়া হলো এটা আমার মাথায় আসছে না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই ভালো বলতে পারবেন।
তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে মামলা করার ইচ্ছা থাকলেও এখন কিছুই বলতে পারছি না। আমি একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি।
এ ব্যাপারে ওসি আক্তার হোসেনকে সাংবাদিকদের নিউজ না করার জন্য অনুরোধ করে বলেন, ‘বিষয়টি ভুলবোঝাবুঝি ছিল। তদন্তকেন্দ্রে কোনো ঘটনা ঘটেনি। যা ঘটেছে নজরুল ইসলাম বাবু কলেজে। কালকে এমপি সাব আমেরিকা গেছে। সব নিজেরা নিজেরা। পেপার পত্রিকায় দেয়া দরকার নাই। ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। ওভাবেই শেষ করে দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আপনারাও আওয়ামী লীগ তারাও আওয়ামী লীগ। বিএনপি হইতো একটা কথা আছিল, ব্যবস্থা নিতে পারতাম। আমি আমার বড় স্যারের লগে কথা কইছি। আওয়ামী লীগের নেতারাই আসছিল। ওইভাবেই শেষ কইরা দিছি। এসব নিয়া এখন আর লেখালেখির দরকার নাই। আর আমার ওইটারও (এটিএসআই মামুন) দোষ আছে। এসব লইয়া ভাই লেখালেখির দরকার নাই। এটা সবারে বইলা দেন। আর অনলাইনগুলা আমি দেখতাছি।’
তবে মারধরের ঘটনা না ঘটলে ওই ৩ পুলিশ সদস্যকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কেন ভর্তি করা হয়েছিল? এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ওসি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং ফোনে কথা না বলে থানায় এসে নিউজ করার জন্য বলেন। সূত্র : দৈনিক যুগান্তর