চাকরি প্রার্থীদের নানান সমস্যা

সম্প্রতি একটি টিভি বিজ্ঞাপন খুব মনে পড়ছে। যেখানে দেখানো হচ্ছে- ক্রেতা প্রাইভেট কার কিনতে গেছেন, বিক্রেতা চমৎকারভাবে গাড়ির গুণাগুণ বর্ণনা করছেন। একপর্যায়ে বলছেন, গাড়ির সব ঠিক আছে- মাঝ্যে মধ্যে শুধু ব্রেক ফেল করে। ক্রেতার কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। শিল্প-সাহিত্য, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, যোগাযোগসহ অনেক খাতে বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তিতে আমরা অনেক এগিয়েছি। এমন আরো অনেক ক্ষেত্রেই বেশ অগ্রগামী হয়েছি। তবে কিছু জায়গায় পেছনে আছি। সেই কিছু জায়গার অন্যতম হলো শিক্ষাব্যবস্থা ও সঠিক কর্মসংস্থান প্রক্রিয়া। মতামতটা একেবারে একান্তই ব্যক্তিগত।

মনে করেন, দেশের সব ঠিকঠাক, উন্নয়নের স্বর্ণযুগে বাস করছি আমরা। কিন্তু শুধু সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় সমস্যা মানে আমাদের অবস্থা হলো ঠিক সেই গাড়ির মতো, মাঝে মধ্যে ব্রেক ফেল করে। মানে ওই গাড়িতে চড়ে বসলে যেমন জীবন নিয়ে আর নিরাপদে বাসায় ফেরা যাবে না, তেমনই সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও দেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব নয়।

শিশু শিক্ষা থেকে শুরু করে একেবারে একজন যুবকের শিক্ষাজীবন শেষ পর্যন্ত যে অবস্থা তা নিয়েই যত মাথাব্যথা। বলবেন, কোথায় কোথায় সমস্যা? বলতে হয়-কোথায় নেই সমস্যা? সব চেয়ে বড় সমস্যা দীর্ঘ সময় পড়ালেখা করা। এত দীর্ঘ সময়ে লেখাপড়া না করার পরামর্শ আরো বহু আগেই ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ সময়ের এ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতে পারে। পাঁচ-ছয় বছর বয়সে এখনকার ছেলেমেয়েরা সাধারণত বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে। ১৬ বা ১৭ বছর বয়সে এসএসসি পাস, ২০ বছরে এইচএসসি ও সেশন জটের কারণে সম্মান কোর্স শেষ করতে করতে বয়স এসে দাঁড়ায় ২৬ বা ২৭ বছরে। অর্থাৎ আমাদের দেশের এখনকার যে শিক্ষাব্যবস্থা তাতে একজন যুবকের নিয়মিত স্কুল-কলেজগামীর করে সুনামের সাথে লেখাপড়া শেষ করতে ২৭ বছর লেগে যায়। অন্য দিকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সের শেষ সীমা হলো ৩০ বছর। সুতরাং দেশের বেকার শিক্ষিতদের চাকরি নামক সোনার হরিণ পেতে হাতে সময় থাকে তিন-চার বছর। যদিও আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সেশনজট, অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ নানা কারণে এমন ঘটনাও দেখা যায়, শিক্ষাজীবন শেষ করতে করতে শিক্ষার্থীর সরকারি চাকরির বয়স শেষ।

আর পেলেই বা কী? চাকরির যে বাজার তা কারো অজানা নয়। প্রতি বছর যে হারে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, তা রীতিমতো হতাশার। অভিভাবকেরা খেয়ে না খেয়ে শত কষ্ট করে সন্তান লেখাপড়া করান। অনেক অভিভাবক পৈতৃক সম্পত্তি এমনকি থাকার বাসভবন পর্যন্ত বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ যোগান দিয়ে থাকেন। শেষে যখন সন্তান চাকরি না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে নেশায় আসক্ত হয়; তখন মা-বাবার দুঃখের সীমা থাকে না। এক দিকে ঋণের বোঝায় নুয়ে পড়েন, অন্য দিকে সন্তানের বিপথ গমনে চোখেমুখে সব দুঃখের ছায়া পরিস্ফুটিত হয়। কেউ কেউ আত্মহননের পথও বেছে নেন।

শ্রমশক্তির জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ৩০ লাখ বেকার মানুষের সংখ্যা রয়েছে। এদের বেশির ভাগই শিক্ষিত। প্রায় ১৫ লাখের মতো তরুণ-তরুণী যারা উচ্চ ডিগ্রিধারী, কিন্তু কোনো চাকরি নেই। চাকরির প্রতিযোগিতার বাজার এতটাই চরমে যে, একটি আসনের বিপরীতে শতাধিক প্রার্থীকে প্রতিযোগিতা করতে হয়। একজন শিক্ষিত যুবক লেখাপড়া শেষে চাকরি পেতে যে প্রধান দু’টি সমস্যায় পড়েন তার একটি হলো- চাকরি প্রবেশের শেষ সীমা ৩০ আর অন্যটি হলো একই দিনে একাধিক পরীক্ষার সময়সূচি। যদিও সারা দেশে চাকরি প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন হয়েছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপসহ বিশে^র প্রায় শ’খানেক দেশের চাকরিতে প্রবেশের বয়স হচ্ছে ৩৫-৫৯ পর্যন্ত। পাশের রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেই চাকরি শুরুর বয়সসীমা ৩৫-৪৫। তা হলে আমাদের দেশের কেন ৩০? অন্য দিকে দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো- একই দিনে সরকারি একাধিক পরীক্ষার সময়সূচি।

এটাতে বেকার যুবকরা পছন্দের পরীক্ষায় শুধু অংশ নিতে পারছেন না তা কিন্তু নয়, এখানে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তের বিষয়টিও রয়েছে। একটি যুতসই চাকরি বগলদাবা করতে প্রাণপনে লড়ে যাচ্ছেন প্রতিযোগিতার এ বাজারে অনেকে। প্রায় সময় তারা চাকরির সময়সূচি বিড়ম্বনায় পড়েন। গত ২৯ মার্চ বাংলাদেশ কম্পিটিশন কমিশনের সব পদের প্রিলি, পূবালী ব্যাংক জুনিয়র অফিসার পদের লিখিত পরীক্ষা, মাদকের উপপরিদর্শক পদের লিখিত পরীক্ষা, কম্বাইন্ড অফিসার ক্যাশ ৫ ব্যাংক প্রিলি, বাংলাদেশ রেলওয়ে বুকিং সহকারী পদের পরীক্ষাসহ আরো মোট ৮-১০টি চাকরির পরীক্ষা ছিল ওই দিন। কিন্তু একজনের পক্ষে এক দিনে তো এত পরীক্ষা দেয়া সম্ভব না, তাও আবার একই সময়ে। কিন্তু বেকার তরুণ-তরুণীকে টাকা দিয়ে ঠিকই পরীক্ষার আবেদন করতে হয়েছিল।

বেকারদের সাথে এ কেমন প্রহসন! যারা রাতে টাকার অভাবে না খেয়ে ঘুমিয়ে পরেন। বাড়ি ভাড়া দিতে না পেরে প্রতি মাসেই যারা বাড়িওয়ালার কটু কথার শিকার হন; ঠিক তাদের টাকাও চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটে খোয়াতে হয়। অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের নজরধারী বা পরিশ্রম অথবা সিস্টেমের একটু রদবদল বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কত বড় একটি সমাধানে আসতে পারে, তা যেন ভাবার সময় পাচ্ছেন না কেউ।

শেষান্তে কথা হলো, সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেবো কোথা। এমন যখন অবস্থা, তবুও ভালোর স্বপ্ন দেখতে হয়। সোনালি সূর্যের অপেক্ষায় থাকতে হয়। খুব অভিমান নিয়ে দুঃখভরা কণ্ঠে বলতে চাই, শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানে পদায়ন প্রক্রিয়ায় যেন দুর্নীতির লেশ মাত্র না থাকে।

লেখক : সাংবাদিক

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top