উপজেলা নির্বাচনে নৌকার বিরোধিতাকারী মন্ত্রী-এমপিদের ওপর চরম ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাদের বিরোধিতার কারণে রেকর্ডসংখ্যক উপজেলায় এবার আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হেরেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে দলের আবেগের প্রতীক ‘নৌকার’ ইমেজই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে এসব মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি উঠেছে দলের অভ্যন্তরে। এমন প্রেক্ষাপটে আপাতত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও এসব মন্ত্রী-এমপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কড়া নজরদারিতে থাকবেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, এবারের উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলে নিজেদের মধ্যে কোন্দল বেড়েছে। বিভক্ত হয়ে পড়েছে তৃণমূল নেতাকর্মীরা। কাদা ছোড়াছুড়িতে সাংগঠনিক ভিতও দুর্বল হয়েছে। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একাধিক উপজেলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। এতে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আর দলের এ অবস্থার জন্য অনেক মন্ত্রী-এমপিকে চিহ্নিত করেছে কেন্দ্র। দলের শৃঙ্খলা রক্ষা এবং সারা দেশে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে অবিলম্বে এসব মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি উঠেছে দলের বিভিন্ন ফোরামে। গতকাল সোমবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকেও অনির্ধারিত আলোচনায় উপজেলা নির্বাচন প্রসঙ্গ এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মন্ত্রিসভার কোনো কোনো সদস্যও নৌকার বিরোধিতা করেছে। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক।’
গত শুক্রবার দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের বৈঠকেও প্রসঙ্গটি আসে। এ সময় সভাপতিমণ্ডলীর অনেক সদস্যই উপজেলা নির্বাচনে অনেক এমপি-মন্ত্রীর আচরণ ও তৎপরতায় বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা অভিযুক্ত মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান ওই বৈঠকে।
সূত্রগুলো জানায়, বিএনপির বর্জনের কারণে উপজেলা নির্বাচনকে জমজমাট করতে এবার নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পাশাপাশি দলের অন্যদেরও প্রার্থিতার সুযোগ তৈরি করে দেয়া হয়। তবে এমপি-মন্ত্রীদের সব পক্ষ থেকে নিবৃত থাকার মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু অজানা আতঙ্কে পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে যান মন্ত্রী-এমপিরা। উন্মুক্ত নির্বাচনে যেখানে তাদের চুপ থাকার নির্দেশনা রয়েছে সেখানে অনেক এমপি-মন্ত্রী অন্তরালে নৌকার বিরোধিতা করেন। শুধু বিরোধিতাই নয়, কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপি নৌকার বিরোধিতা করে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে সরাসরি প্রচারণায় শামিল হন। অনেকে আবার নৌকার প্রার্থী ও প্রশাসনকেও নানা ধরনের হুমকি-ধামকি দিয়ে নৌকার পরাজয় নিশ্চিত করেন। বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি আওয়ামী লীগ ও সরকারের শীর্ষ কর্তারা।
দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, নৌকার বিরোধিতাকারী এসব মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে কেন্দ্রে একাধিকবার অভিযোগ জানিয়েছেন নৌকার প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। এসব অভিযোগ এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের মাধ্যমে প্রায় অর্ধশত মন্ত্রী-এমপির তালিকা করে কেন্দ্র। সেই রিপোর্ট দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করা হয়। তার মধ্যে গাজীপুরের সিনিয়র মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে গাজী গোলাম দস্তগীর (বীরপ্রতীক), নাটোরের প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সংসদ সদস্য অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস ও সংসদ সদস্য শহীদুল ইসলাম বকুল, কুমিল্লা-২ আসনের এমপি সেলিমা আহমাদ মেরী, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া-৫ আসনের এবাদুল করিম বুলবুল, টাঙ্গাইল-৪ আসনের সংসদ সদস্য হাসান ইমাম খান সোহেল হাজারী, ময়মনসিংহ-৯ আসনের আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিন, মুন্সীগঞ্জ সদরে সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস, খুলনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দসহ আরো অনেক এমপি-মন্ত্রী রয়েছেন। এসব মন্ত্রী-এমপি কোন সময় অন্তরালে এবং কখনো সরাসরি নৌকার প্রার্থীর বিরোধিতা করেছেন। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে নৌকার প্রার্থী এবং জেলা আওয়ামী লীগ সংবাদ সম্মেলন করেও অভিযোগ জানান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ও নির্বাচন কমিশনের আদেশের পরও সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রীদের লাগাম টানা যায়নি।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত নীতি অনুযায়ী এ নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিরা প্রচার চালাতে পারবেন না। তারা কোনো প্রার্থীর পক্ষে কাজও করতে পারবেন না। কিন্তু তারপরও তাদের নিবৃত্ত করা যায় না। তারা পেছন থেকে প্রভাব বিস্তার তো করছেনই, প্রকাশ্যেও বেশ তৎপর অনেকে। অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া নির্বাচন চারটি ধাপের নির্বাচনে কমপক্ষে দুই ডজন এমপি-মন্ত্রীকে সতর্ক করে নির্বাচন কমিশন। ইসির নির্দেশ অমান্য করে এলাকায় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের সহকারী ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (এপিএস) মিজানুর রহমান মিজানের বিরুদ্ধে মামলা করে ইসি। এ ঘটনায় লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলা পরিষদ নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হয় নির্বাচন কমিশন।
দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের দুই দিন আগে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও গাইবান্ধা-৫ আসনের (ফুলছড়ি ও সাঘাটা) সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়াকে এলাকা ছাড়ার নোটিশ দেয় ইসি।
জানা গেছে, এলাকায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতেই বেশ তৎপর ছিলেন অভিযুক্ত মন্ত্রী-এমপিরা। নিজেদের স্বার্থেই আওয়ামী লীগের চরম আবেগের প্রতীক ‘নৌকাকে’ ডুবিয়ে দেন তাদের অনেকে। বিষয়টি মোটেও ভালোভাবে নেননি দল প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের তিনজন নেতা আলাপকালে বলেন, যারা নৌকার বিপক্ষে কাজ করে তারা কখনো বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী তাদের ওপর চরম ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। তবে আপাতত তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়া না হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কড়া নজরদারিতে থাকবেন অভিযুক্তরা। ভবিষ্যতে তাদের আমলনামা যাচাই করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যেহেতু বিএনপি নেই তাই কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে কোনো দলীয় প্রভাব বিস্তার না করার নির্দেশনা ছিল। আর আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধেও উদারনীতি গ্রহণ করা হয়েছে। স্থানীয় এ নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীদের নিবৃত থাকতে বলা হয়েছে। যোগ্য ও জনপ্রিয়রা নির্বাচিত হয়ে আসুকÑআওয়ামী লীগের প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু দলের সেই নির্দেশনা অমান্য করে অনেকে নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের ব্যাপারে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা চলছে। শুক্রবার দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় বিষয়টি আলোচনায় আসতে পারে। দেখা যাক কি হয়।’