শিক্ষা প্রশাসনে বড় রদবদল করা হয়েছে গত পরশু রাতে প্রকাশিত পৃথক তিনটি আদেশে। শিক্ষা প্রশাসনের মূল নিয়ন্ত্রক মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) উচ্চপর্যায়ের ১৮ কর্মকর্তাকে একযোগে বদলি করা হয়েছে। তাদের সবাইকে ওএসডি (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) করা হয়েছে। শিক্ষা ক্যাডারের অপেক্ষাকৃত জুনিয়র ২৬ জন কর্মকর্তাকে মাউশিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পদায়ন করা হয়েছে। এতে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা রীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে সদ্য অধ্যাপক পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়েছে।
শিক্ষা ক্যাডারের সিনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ-হতাশা দেখা দিয়েছে বলে সোমবার জানা গেছে। রদ-বদলের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। মন্ত্রণালয় ও মাউশির বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নতুন মন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পর একটি রদবদলের কথা শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু ঘটে যাওয়া রদবদল ক্যাডারের সিনিয়র কর্মকর্তাদের কারো কাছেই প্রত্যাশিত ছিল না।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর আমলে ক্যাডারের সিনিয়র কর্মকর্তাদের অনেকেই নানাভাবে বঞ্চিত হয়েছিলেন, নতুন মন্ত্রীর আমলের শুরুতেই তা-ই ঘটল বলে মন্তব্য করেছেন তারা। সংশ্লিষ্টদের মতে, সাবেক মন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব (পিএস) মন্মথ রঞ্জণ বাড়ৈ সিন্ডিকেটের হাতেই আবারো বন্দী হলো শিক্ষা প্রশাসন। মন্মথ রঞ্জণ বাড়ৈ সিন্ডিকেটের জুনিয়র কর্মকর্তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম-প্রকাশ্য দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনার অভিযোগ রয়েছে।
মন্ত্রণালয় ও মাউশি সূত্রে বলা হয়, যাদের বদলির আদেশ হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেও নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা এবং বছরের পর বছর একই পদে থেকে নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। কোনো কোনো কর্মকর্তার বদলির আদেশ হওয়ার ছয় মাস যেতে না যেতেই বর্তমান সরকারের বড় নেতা-মন্ত্রীর তদবিরে আবার স্বপদে ফিরে আসার নজির ছিল।
গত রোববার রাতে প্রকাশিত পৃথক তিনটি বদলি-পদায়ন আদেশে যারা নতুন পদ পেয়েছেন, তাদের মধ্যে মাত্র ছয় মাস আগে অধ্যাপক পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে শিক্ষা প্রশাসনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে বসানো হয়েছে। মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) পদ এটি। এখানে এ যাবৎ এত জুনিয়র কর্মকর্তাকে কখনোই পদায়ন করা হয়নি। তিনি এর আগে ঢাকা বোর্ডের সচিব পদে পদায়নের সময়ও একই ঘটনা ঘটেছিল।
বাড়ৈ সিন্ডিকেটের আলোচিত জুনিয়র এ কর্মকর্তা নিজেকে ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের বড় নেতা বলে দাবি করেন এবং ‘২১ বছর চাকরি করার পর আর কত দিন লাগবে সিনিয়র হতে’ বলে দম্ভ করেন। জানা গেছে, তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও বিপরীত রাজনীতির সদস্য বলে সন্দেহের চোখে ছিলেন।
এ দিকে মাউশির গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিচালক ও উপপরিচালক এবং সহকারী পরিচালক পদে যাদের পদায়ন করা হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই অপেক্ষাকৃত জুনিয়র ক্যাডার কর্মকর্তা। তারা আগামী দিনগুলোতে শিক্ষা প্রশাসনকে কিভাবে পরিচালনা করবেন, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। এ ছাড়া নতুন পদায়নকৃতদের অনেকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ ছিল আগে থেকেই। মাউশির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আগে থেকেই দুর্নীতি এবং সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি কলেজ, শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের কাজ নিয়ে যেভাবে হয়রানি ও ঘুষবাণিজ্যের অভিযোগ ছিল তা নতুন করে চাঙ্গা হবে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্সের ব্যাপারে সরকারের বিঘোষিত নীতি কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টদের প্রায় সবাই।
শিক্ষা ভবনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নতুন মুখ : ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব সদ্য প্রফেসর হওয়া মো: শাহেদুল খবির চৌধুরীকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের কলেজ ও প্রশাসন শাখার পরিচালক করা হয়েছে। অধিদফতরের সরকারি কলেজ শাখার উপপরিচালক পদে সংযুক্ত থাকা প্রফেসর প্রবীর কুমার ভট্টাচার্যকে প্রশিক্ষণ শাখার পরিচালক করা হয়েছে। ওএসডি থাকা প্রফেসর মো: আমির হোসেনকে শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (এম অ্যান্ড ই উইং, সেসিপ) করা হয়েছে।
মুন্সীগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম খানকে শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (ফিন্যান্স অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) করা হয়েছে। টাঙ্গাইলের সরকারি সা’দত কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর মো: শহীদুজ্জামান মিয়াকে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় নির্বাচিত বেসরকারি কলেজগুলোর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক করা হয়েছে।
শরীয়তপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো: মনোয়ার হোসেনকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক (সেসিপ), সরকারি তিতুমীর কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো: রুহুল আমিনকে অধিদফতরের উপপরিচালক (প্রশাসন) ও নীলফামারীর সৈয়দপুর সরকারি কারিগরি কলেজের অধ্যক্ষ শাহ মো: আমির আলীকে একই অধিদফতরের উপপরিচালক (কলেজ-১), চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজের সহযোগী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে একই দফতরের উপপরিচালক (একিউএইউ) করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজের সহকারী অধ্যাপক মীর রাহাত মাসুমকে অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (কলেজ-৪), মাউশি অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (কলেজ-৪), মো: জাকির হোসেনকে এই দফতরের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) এবং ওএসডি থাকা অসীম কুমার বর্মনকে একই দফতরের সহকারী পরিচালক-২ (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর) করা হয়েছে।
আজিমপুর সরকারি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলার সহকারী অধ্যাপক কাওসার আহমেদকে মাউশি অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক) পদে পদায়ন করা হয়েছে। নাটোরের গোল-ই-আফরোজ সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনার সহযোগী অধ্যাপক আকতারুজ্জামান ভূঁইয়াকে উপ-পরিচালক (শারীরিক শিক্ষা) ও বি এম কলেজের হিসাববিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমানকে সহকারী পরিচালক (শারীরিক শিক্ষা) এবং সরকারি পি সি কলেজের অর্থনীতির প্রভাষক রিজওয়ানুর রহমানকে মাউশি অধিদফতরের গবেষণা কর্মকর্তা (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) করা হয়েছে।
এ ছাড়াও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের ওএসডিতে থাকা সহকারী অধ্যাপক খান আব্দুল্লাহ আল আসাদকে কুমিল্লার গৌরীপুর মুন্সি ফজলুর রহমান সরকারি কলেজে বদলি করা হয়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও সচিব পদে নতুনদের পদায়ন : ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক তপন কুমার সরকারকে ঢাকা বোর্ডের সচিব, মাদরাসা বোর্ডের পরিদর্শক অধ্যাপক মো: আবুল বাসারকে ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো: রফিকুল ইসলামকে উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক করা হয়েছে। কুমিল্লার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের একাডেমিক উপ-সচিব (প্রেষণে) নূর মোহাম্মদকে একই বোর্ডের সচিব (প্রেষণে) পদে পদায়নের আদেশ দেয়া হয়েছে।
নরসিংদী সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনার অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন দেবনাথকে শিক্ষা অধিদফতরের প্রকল্প পরিচালক (সিলেট, খুলনা, বরিশাল বিভাগীয় শহরে ৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণ)।
মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও সচিব পদে রদবদল : দুয়ারিপাড়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো: ছিদ্দিকুর রহমানকে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের রেজিস্ট্রার করা হয়েছে। এ কর্মকর্তা মাউশিকে উপ-পরিচালক (মাদরাসা) থাকাকালে মাদরাসা শিক্ষকদের হয়রানি ও নানাভাবে দুর্ব্যবহারে বহু অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুয়ারিপাড়া সরকারি কলেজে বদলি করা হয়েছিল। বোর্ডের উপ-রেজিস্ট্রার (কমন সার্ভিস) পদে থাকা মো: কামাল উদ্দিনকে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক করা হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম) উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়ন) ড. রিয়াদ চৌধুরীকে কন্ট্রোলার অব পাবলিকেশন্স করা হয়েছে।
সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের সহকারী অধ্যাপক তৈয়ব হোসেন সরকারকে উপ-রেজিস্ট্রার (কমন সার্ভিস) এবং ওএসডি থাকা স্বরূপকাঠি সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক জিয়াউল আহসানকে পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) করা হয়েছে।
মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের রেজিস্ট্রার মো: মুজিবব রহমান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এস এম মোর্শেদ বিপুল, কন্ট্রোলার অব পাবলিকেশন্স শিব্বির আহমেদ, মাদরাসা শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) ড. মোহম্মদ ছরওয়ার আলম, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (মাধ্যমিক) তারেক বিন আজিরকে ওএসডি করা হয়েছে।
ওএসডি করা মাউশির কর্মকর্তারা হলেন : মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) প্রফেসর ড. মো: আবদুল মালেক, পরিচালক (এমঅ্যান্ডই উইং, সেসিপ ) প্রফেসর ড. মো: সেলিম মিয়া, পরিচালক (ফিন্যান্স অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী, প্রকল্প পরিচালক (তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় নির্বাচিত বেসরকারি কলেজগুলোর উন্নয়ন প্রকল্প) প্রফেসর ড. আলমগীর হোসেন চৌধুরী, উপপরিচালক (প্রশাসন) মো: শফিকুল ইসলাম সিদ্দিকী, উপপরিচালক (এ কিউ এ ইউ) মো: খুরশিদ আলম, সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মো: জাকির হোসেন, সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ড. আ ক ম খলিলুর রহমান, সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক) সবুজ আলম, ওএসডিতে থাকা সহকারী পরিচালক (শারীরিক শিক্ষা) সাইফুল ইসলাম, গবেষণা কর্মকর্তা (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) কামরুন নাহার, প্রকল্প পরিচালক (সিলেট, খুলনা, বরিশাল বিভাগীয় শহরে ৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণ) প্রফেসর শাহ আলম, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা ঢাকা অঞ্চলের সেসিপ পরিচালক (প্রেষণে) প্রফেসর মো: ইউসুফ।