কখনো কখনো হাজার হাজার শব্দ লিখে যা বোঝানো না যায়, তার চেয়ে বেশি বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারে একটি ছবি। সেটি যেন আবারো প্রমাণিত হলো অস্ট্রেলিয়ার এক কার্টুনিস্টের আকা একটি ছবির মাধ্যমে। অনলাইনে ছড়িয়ে পরা ছবিটি লাখো বার লাইক কমেন্ট শেয়ার হয়েছে। একটি ছবিতেই যেন ফুটে উঠেছে হাজারো শব্দের কথামালা। সহানুভূতি, প্রতিবাদ, সংহতি সব কিছু যেন বলা হয়ে গেছে এই একটি ছবির মাধ্যমে। খুবই সাধারণ, কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী বার্তাপূর্ণ একটি ছবি এটি।
১৫ মার্চ ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ৫০ জন মুসুল্লি নিহত হওয়ার পর নিহতদের স্মরণে এই ছবিটি একেঁছেন অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা দ্য ক্যানবেরা টাইমসের কার্টুনিস্ট প্যাট ক্যাম্পবেল। নামাজরত বিভিন্ন ভঙ্গিতে ৫০জন মুসুল্লির ছবি সাজিয়ে একটি রুপালি ফার্ন পাতা তৈরি করেছেন তিনি। সেখানে দেখা যায় কেউ দাড়িয়েছে আছেন নামাজের ভঙ্গিতে, কেউ রুকু করছেন, কেউ সেজদায়, কেউবা আবার মুনাজাতরত। ফার্ন পাতা নিউজিল্যান্ডের জাতীয় প্রতীক। দেশটির জাতীয় পতাকা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই ব্যবহৃত হয় এই রুপালি রংয়ের ফার্ন পাতা।
হত্যাকাণ্ডের পরদিন শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই এই ছবিটি একেঁছেন প্যাট ক্যাম্পবেল। নৃসংস সেই ঘটনার পর নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী যেমনভাবে বলেছিলেন, নিহতরা আমাদেরই লোক, এটি তাদেরই দেশ। ক্যাম্পবেলের এই ছবিটির মাধ্যমেও যেন ফুটে উঠলো সেই বক্তব্য। নিহত মুসলমানরা সবাই অভিবাসী হলেও তারা যে নিউজিল্যান্ডেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ, তারা যে দেশটির অস্তিত্বের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে আছেন তাই ফুটে উঠেছে মুসুল্লিদের ছবি দিয়ে তৈরি ফার্ন পাতায়। যেন এক ছবিতেই বলা হয়ে গেছে হত্যাকাণ্ড নিয়ে সব কথা।
ছবিটি প্রকাশের পর অনলাইন ব্যবহারকারীরা লুফে নিয়েছেন সেটি। সবাই একবাক্যে প্রশংসা করেছেন চমৎকার আইডিয়া ও শিল্পকর্মের। অনেকেই নিজের ওয়ালে শেয়ার করেছেন ছবিটি। অনেক সংস্থা নিহতদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে গিয়ে ছবিটি ব্যবহার করেছে। নিউজিল্যান্ডের দ্যা স্টাফ পত্রিকা জানিয়েছে, ছবিটির জন্য ক্যাম্পবেল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অভিনন্দন পেয়েছেন। মালয়েশিয়া থেকে কানাডা, মিসর থেকে আমেরিকা- বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষ শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তাকে।
কার্টুনিস্ট ক্যাম্পবেল এ ছবিটির গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে বলেন, আমি সঠিক বলতে পারবো সংখ্যাটি কত, তবে সারা দুনিয়াতেই ছড়িয়ে গেছে সেটি। অনেক মুসলমান আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে বার্তা পাঠিয়েছে, এখনো প্রতিদিন আসছে এমন বার্তা। অনেক গ্রুপ তাদের ক্যাম্পেইন বা তহবিল সংগ্রহের কাজে ছবিটি ব্যবহারের জন্য আমার অনুমতি চাইছে। এর চেয়ে আনন্দের কিছু আর হয় না।
ছবিটির চিন্তা কিভাবে এলো এমন প্রশ্নে ক্যাম্পবেল বলেন, পরদিন সকালে যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখনও মাথার মধ্যে ঘুরছিলো সেই হত্যাকাণ্ডের কথা। এরপরই এমন একটি ছবি আকাঁর চিন্তা মাথায় আসে। আমি জানি রুপালি ফার্ন পাতা নিউজিল্যান্ডের জাতীয় জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তারপর সেটি আঁকার সিদ্ধান্ত নেই নিহতদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে।
তিনি বলেন, নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এটি একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস। প্রথমে আমি ঘটনার সময় নিহত ৪৯ জনের ছবি ব্যবহার করেছিলাম, পরে (হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একজনের মৃত্যুর পর) একটি প্রতীক যোগ করা হয়। আমি সবাইকে তুলে ধরতে চেয়েছি। কার্টুনিস্ট ক্যাম্পবেল বলেন, ভাবলাম এই ঘটনা নিয়ে আমার করার মতো একটি কাজই আছে, সেটিই করে ফেললাম।
সাধারণের মধ্যে অসাধারণ এই ছবিটি নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন ক্যাম্পবেল। কোন বাক্য ছাড়াই যেটি ঘটনার ভয়াবহতা ও মানবিকতাকে এক সাথে তুলে ধরছে। তাছাড়া এখানে আশা, নিরবতা, ভালোবাসার শক্তি সব কিছুই ফুটে উঠেছে এই একটি ছবিতে।
ক্যাম্পবেল বলেন, শনিবার যখন ছবিটি আঁকি, তখন ভাবিনি এটি এত প্রশংসা পাবে। আমার অজান্তেই এটি ফেসবুক ও টুইটারে এতটা ছড়িয়ে পড়েছে। আমি খুশি যে সারা বিশ্বের মর্মাহত মানুষের জন্য এটি একটি সান্ত্বনা হিসেবে কাজ করেছে। ছবিটি নিজেই একটি শক্তি হয়ে উঠেছে।
ছবিটি ডিজিটাল মাধ্যমে আঁকা। ক্যাম্পবেল বলেন, সাধারণত আমি কোন ছবি আঁকতে গেলে আগে পেন্সিল দিয়ে খসড়া করি; কিন্তু এদিন আমি জানতাম আমি কী করতে চাই, তাই সরাসরি ড্রয়িং ট্যাবলেটটি নিয়ে বসে পড়ি।
অনেকেই ছবিটি ব্যবহারের অনুমতি চাইছে জানিয়ে এই শিল্পী বলেন, সাধারণত ছবি ব্যবহারে কোন অনুমতি লাগে না, তবু এটি বিশেষ একটি কাজ। লোকেরা তাদের কাজের জন্য এটি প্রিন্ট করছেন, অনলাইনে তহবিল সংগ্রহের জন্য প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করছেন, আমি সবাইকে এটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে এবং সর্বোচ্চ রেজুলেশনের ছবিটি অনলাইনে পোস্ট করেছি তাদের সুবিধার জন্য। ছবিটি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আমার পত্রিকা দ্যা ক্যানবেরা টাইমসের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ।
ইতোপূর্বে ছবি একে পুরস্কার যেতা ক্যাম্পবেল এই ছবিটির জন্যও একাধিক মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন বলে অনেকেই ধারণা করছেন। যদিও এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না ক্যাম্পবেল। তিনি এখনো ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার দুঃখ ভুলতে পারছেন না। বলেন, জীবনে অনেক সময় কাটিয়েছি শহরটিতে। আমার বন্ধুদের অনেকে আছে ক্রাইস্টচার্চের। এমন সুন্দর একটি শহর এই ট্রাজেডি নিয়ে হাজির হবে ভাবতে পারিনি।
ক্যাম্পবেলন বলেন, আমারও পুত্র সন্তান আছে; কিন্তু যখন দেখি বাবা ও পুত্রকে একই সাথে কবরে শোয়ানো হচ্ছে সেটি খুবই কষ্টের। এই অপরাধ বিশ্বের যে প্রান্তেই ঘটুক, সেটি ক্ষমার অযোগ্য।