এবার আত্মঘাতী ড্রোন : ফের অস্ত্রবাজারের শিরোনামে কালাশনিকভ

১৯৯৩ সাল। সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রথমবারের জন্য অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদের বাণিজ্য মেলা আয়োজন করে। পৃথিবীর বৃহত্তম অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের প্রচার ও বিক্রির লক্ষ্যে যোগ দিয়েছিল তাতে। মেলায় যোগ দেয়ার জন্য কাস্টমস পেরনোর সময় শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারা আটকে দিয়েছিলেন জেনারেল মিখাইল কালাশনিকভকে। আবুধাবির সদাসতর্ক কাস্টমস কর্তারা দু’বোতল ভদকা খুঁজে পেয়েছিলেন রাশিয়ান জেনারেলের লাগেজে। কারণ, পর্যটকদের এই দেশে অ্যালকোহল আনা নিষেধ। তাই রাশিয়ার বিখ্যাত রপ্তানিযোগ্য পণ্য ভদকার বোতল দু’টি বাজেয়াপ্ত করার পরই জেনারেল কালাশনিকভকে অস্ত্র মেলায় যোগ দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল।

সেখানে সারা দুনিয়া থেকে আসা অস্ত্র ক্রেতাদের সামনে রাশিয়ার সর্বসেরা অস্ত্র কালাশনিকভ বিপণনের সুযোগ পান তিনি। পরিহাসের বিষয় হল, কাস্টমস কর্তারা জেনারেলের কাছ থেকে অ্যালকোহল বাজেয়াপ্ত করলেও, অ্যালকোহলের চেয়ে বেশি মৃত্যুর কারণ আগ্নেয়াস্ত্রের প্রচার ও বিক্রির লক্ষ্যে দেশে ঢোকার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তাকে। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি রাশিয়ার অ্যাসল্ট রাইফেল আভতোমাত কালাশনিকভ-৪৭’কে। আম-আদমির কাছে যা পরিচিত একে-৪৭ নামেই। এত বছর পরেও ভয়ঙ্কর মৃত্যু-মেশিনই রয়ে গিয়েছে তা। কারণ, এটা পুরনো হয় না বা মরচে ধরে না। এমনকি মাটির নিচে চাপা দিলে কিংবা পানিতে ফেলে দিলেও। সেই মিনিটে ৬ হাজার রাউন্ড হারে হুড়মুড় করে বুলেট উগরে দেয়। চিরকাল। অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের মতে, একে-৪৭ বিংশ শতকের সেরা অস্ত্র। জনপ্রিয়তার জন্য এই রাইফেল ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে’ স্থান করে নেয়।

সেই জনপ্রিয়তা এবং কার্যকারিতাকে পাথেয় করে নতুন আত্মঘাতী ড্রোন বানিয়ে ফের অস্ত্রবাজারের শিরোনামে উঠে এসেছে কালাশনিকভ। আর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এর আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনী হয়েছে সেই আবুধাবির ডিফেন্স এগজিবিশনেই। পোশাকি নাম ‘কেইউবি-ইউএভি’। চার ফুট চওড়া। টানা ৩০ মিনিট ৮০ মাইল বেগে উড়তে পারে। ৪০ মাইল দূরে বিস্ফোরক বয়ে নিয়ে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম এই ড্রোন। নির্মাতাদের দাবি, আগামী দিনে যুদ্ধের সংজ্ঞাই বদলে দিতে চলেছে এই আত্মঘাতী ড্রোন। কারণ, এতে ব্যবহারকারী দেশের ক্ষয়ক্ষতি একেবারে শূন্য শতাংশ।

মার্কিন ও ইজরায়েলি ড্রোনের থেকে এর দাম তুলনামূলকভাবে অনেকটাই কম হওয়ায় প্রতিরক্ষা বাজেটেও খুব বেশি বরাদ্দ বাড়াতে হবে না। ফলে এই আত্মঘাতী ড্রোন যে একে-৪৭’এর যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠতে চলেছে, তা ডিফেন্স এগজিবিশনে যোগ দেয়া দেশগুলোর প্রতিনিধিদের কথাতেই স্পষ্ট। কারণ, যে কারণে একে-৪৭ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত, সেই একই গুণ সমানভাবে রয়েছে কালাশনিকভ গ্রুপের নয়া অস্ত্রে—কম দাম, ব্যাপক কার্যকারিতা এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য।

শত্রুপক্ষের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ের পরিবর্তে যুদ্ধ এখন অনেক বেশি প্রযুক্তিগত। এই লড়াইতে বিপক্ষ শিবিরকে যে টেক্কা দিতে পারবে, অ্যাডভান্টেজ তারই। কালাশনিকভ গোষ্ঠীর অন্যতম অংশীদার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রসটেক আর্মস ম্যানুফাকচারার চেয়ারম্যান সের্গেই চেমেজোভের দাবি, ‘একে-৪৭ যেমন অস্ত্র দুনিয়ায় বিপ্লব এনেছিল, তারই পুনরাবৃত্তি করতে চলেছে কেইউবি-ইউএভি। এই ড্রোন বানিয়ে আধুনিক যুদ্ধের দিকে এক পা অগ্রসর হলাম আমরা।’ তবে শুধু নির্মাতা সংস্থাই নয়, এই ড্রোনকে দরাজ প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব ইলিনোয়িসের ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের অধ্যাপক নিকোলাস গ্রসম্যান। তার দাবি, ‘যে দেশই কিনুক না কেন, তাদের হাতে চলে আসবে দূর নিয়ন্ত্রিত বোমার ক্ষুদ্র সংস্করণ। আমেরিকারও এরকম কিছু ড্রোন আছে, কিন্তু সেগুলোর দাম অত্যধিক চড়া। বরং কেইউবি-ইউএভিকে কম দামে ছোট ক্রুজ মিসাইল বলা যেতেই পারে।

২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর ৯৪ বছর বয়সে মারা যান মিখাইল কালাশনিকভ। এর বছর দেড়েক আগে অর্থাৎ, ২০১২ সালের মে মাসে তিনি রাশিয়ার একটি রক্ষণশীল গির্জার বিশপ কিরিলকে একটি চিঠি। চিঠিটি প্রকাশ করেছিল রাশিয়ার ক্রেমলিনপন্থী ইজভেস্তিয়া পত্রিকা। তাতে কালাশনিকভ লিখেছিলেন, ‘আমি অসহনীয় আত্মযন্ত্রণায় ভুগছি। বয়স যত বাড়ছে ততই একটি প্রশ্ন আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আমার তৈরি করা অস্ত্র কত শত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে!’ হয়তো তাই, প্রায় জীবনভর অস্ত্রশস্ত্রের পরীক্ষা করতে গিয়ে কালাশনিকভ শেষজীবনে প্রায় বধির হয়ে গিয়েছিলেন। ইযহেভস্ক কারখানার কাছেই থাকতেন তিনি। আজও সেখানে একে-৪৭ তৈরি হচ্ছে কাড়ি কাড়ি। সেদিকে ফিরেও তাকান না তার স্ত্রী এক্যাটরিনা কালাশনিকভ। সেই কারখানাতেই আত্মঘাতী ড্রোনের উৎপাদন শুরু করার কথা কালাশনিকভ গোষ্ঠীর।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top