বিদেশগামী নারী কর্মীরা ট্রেনিং ছাড়াই পাচ্ছেন সার্টিফিকেট

বিদেশগামী নারী কর্মীদের অনেকেই টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে (টিটিসি) না গিয়েই বিদেশ যাওয়ার সার্টিফিকেট হাতে পাচ্ছেন। কিন্তু জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক (বহির্গমন)-এর দফতরে সর্বশেষ মৌখিক পরীক্ষার সময় অনেকেই ধরা পড়ছেন।

নিয়ম মোতাবেক বিদেশে নিয়োগ কর্তার বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করার সময় দৈনন্দিন যেসব আরবি ভাষা জানা জরুরি তার কিছুরই উত্তর দিতে পারছেন না সাক্ষাৎ দিতে আসা বিদেশগামী নারীরা। তবে কোনো কোনো এজেন্সির পাঠানো নারী কর্মীরা আবার দু-একটি প্রশ্নের উত্তর দ্রুতই দিতে পারছেন। যারা পারছেন না, তাদের বহির্গমন ছাড়পত্রের ক্লিয়ারেন্স না দিয়ে আবারো ট্রেনিং সেন্টারে যেতে বলা হচ্ছে।

গত রোববার প্রবাসী কল্যাণ ভবনের দ্বিতীয় তলার জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর বহির্গমন বিভাগের পরিচালকের দফতরে বিদেশগামী নারী কর্মীদের সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় ট্রেনিং সেন্টারে না গিয়েই সার্টিফিকেট পাওয়ার চাঞ্চল্যকর বিষয় ধরা পড়ে।

এ সময় সংশ্লিষ্ট এজেন্সির মালিকদেরও সাক্ষাৎপর্বে হাজির থাকতে দেখা যায়। তবে যেসব নারী কর্মীকে ট্রেনিং না নেয়ার কারণে বিদায় দেয়া হয় তাদের বিষয়ে অবশ্য রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা জোর প্রতিবাদ জানিয়ে বলার চেষ্টা করেন, স্যার আমাদের এখানে কী করার আছে, আমরা তো তাদের ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়েছি। এখন তারা যদি সেখানে কিছু শিখতে না পারে তাহলে এর দায় কি আমাদের?

ঠাকুরগাঁও টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার থেকে ট্রেনিং নিয়ে সাক্ষাৎ দিতে আসা ৪০ বছর বয়সী রওশান আরা ও রেনু আরা বেগমকে ডাকা হয় পরিচালকের রুমে। এ সময় জাফর ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারীও সেখানে উপস্থিত হন। পরিচালক মো: আতাউর রহমান প্রথমে রওশন আরার কাছে জানতে চান, আপনি কোথায় ট্রেনিং করেছেন।

ঠাকুরগাঁও জানালে তখন তিনি বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ে কি ট্রেনিং হয়, নাকি এমনি সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছে? আরবি শিখেছেন কিছু। ‘আচ্ছা বলেন তো, ‘আমি বিপদে আছি’ এটার আরবি কী। কারণ, ওখানে গেলে আপনাদের বিপদই বেশি হবে। আপনারা সেখানে গেলে প্রথমেই ঝামেলার মধ্যে পড়বেন। তখন রাত ৩টায় বাজে আমাকে ফোন করে বলবেন, স্যার আমি বিপদে আছি। আমাকে নিয়ে যান, না হলে আমি কালকেই মরে যাবো।’

এরপর তিনি বলেন, আচ্ছা বলেন তো আতিকা খুলুস অর্থ কী। এ কথা বলার পর আমতা নামতা শুরু করেন মহিলা। তার কাছে আবার প্রশ্ন করা হয় আচ্ছা বলেন তো, আতিনি খুলুস অর্থ কী? তখন মহিলা বলেন, মোবাইল। এ সময় পরিচালক তার কাছে জানতে চান আপনি আসলেই ট্রেনিং সেন্টারে গেছেন কি না? আমি বিপদে আছি এর অর্থ হলো আনাফি মুশকিলা।

আমাকে সাহায্য করো এর আরবি কী জানতে চাইলে মহিলা এরও কোনো উত্তর দিতে পারেননি। এ সময় অবশ্য নারী কর্মী পরিচালককে বলেন, আমি ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হওয়ার সময় শুধু একবার গেছিলাম। তাল্লাজাকি অর্থ কী? আপনি বিদেশে গেলেই প্রথমে এই শব্দটার সাথে সাক্ষাৎ হবে। এটার কোনো উত্তর দিতে পারেননি তিনি।

এরপর ডাকা হয় রেনু আরা বেগমকে। রেনু আরা জানান তিনিও ঠাকুরগাঁও এর একই সেন্টার থেকে ট্রেনিং নিয়েছেন। ‘পুতুর গাদা আসা’ এটা কী জিনিস, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি। তখন পরিচালক বলেন, এর অর্থ তো আমি না। আমি কে বলে আতিহি। ‘আনা মাবাদ্বিক রোজ’ অর্থ কী। তখন বিদেশগামী নারী কর্মী পরিচালককে বলেন, ভাত না ? তখন পরিচালক তাকে পাল্টা বলেন, আরে আপনি আমাকে প্রশ্ন করতেছেন কেনো? আচ্ছা বলেন তো মামা কে পুরুষ না মহিলা? তখন মহিলা বলেন, পুরুষ।

এ সময় পরিচালক আতাউর রহমান তাকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনিতো আরবি ভালোই শিখেছেন ? শিখা খুব ভালোই হইছে। টিটিসিতে যাননি তাহলে উত্তর দেবেন কেমনে? তখন রেনু আরা বলেন, না স্যার আমি ট্রেনিং সেন্টারে গেছি। তাহলে কী শিখছেন ? ঘোড়ার ডিমও তো শিখেন নাই।

আচ্ছা বলেন, শুক্কার কী আর মিলো কী। দুটো একই জিনিস। এরও উত্তর দিতে পারেননি। শুক্কার হলো চিনি আর মিলো হলো লবণ। এ সময় পরিচালক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ওখানে যাওয়ার পর আপনাকে যখন মাইর দিবে, বারান্দায় ফেলে রাখবে তখন দূতাবাস থেকে এসে আউটপাশ দিয়ে বিমানে তোলো হবে। দু’জনকেই আবার একমাস ট্রেনিং দিয়ে আসার জন্য বলেন পরিচালক।

এ সময় দাঁড়ানো জাফর ইন্টার ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী পরিচালককে উদ্দেশ করে বলেন, আপনারা শুধু এদের দুই এয়ারপোর্ট পার করে দিতে পারলেই দায়িত্ব শেষ। তখন এজেন্সির মালিক পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, স্যার আপনারা নারী শ্রমিক বিদেশে পাঠানোই বন্ধ করে দেন। আমি মালিক। আমিও পাঠাইতে চাই না।

আমার দালাল ওনাদের ট্রেনিং করাইয়া আইন্যা আমার হাতে সার্টিফিকেট দিছে। আমি তো আর সেখানে যাইনি। তাদের নাম-ঠিকানা আমি অনলাইনে দেখেছি। স্যার ট্রেনিং না করিয়ে ট্রেনিং সেন্টার থেকে সার্টিফিকেট দেয় এটা তো আপনার ডিজিও জানে ? কিন্তু সার্টিফিকেট জাল পাইলে আমাকে পানিশমেন্ট দেন স্যার। আমার কোনো আপত্তি নাই।

ওরা আমাকে যেটা বলেছে ট্রেনিং সেন্টারে ওদেরকে ১৬-১৭টি কথা শিখানো হয়। এরপর সিলেটের ট্রেনিং সেন্টার থেকে আসা দুজন নারী কর্মীর কাছে প্রশ্ন করা হলে তারা দু-একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেন। আল আব্বাস ইন্টারন্যাশনালের কর্মী দু’জনের একজন এর আগে দুবাই ছিলেন বলে জানান। পরে দু’জনকেই বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেয়া করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে সারা দেশে টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে এক শ্রেণীর দালালদের যোগসাজশে বিদেশগামী নারী শ্রমিকরা ভর্তি হন। এরপর ঠিকমতো ক্লাস না করে বাড়িতে চলে যান। পরে তাদের হাতে সার্টিফিকেট এসে পড়ে। তবে কোনো কোনো ট্রেনিং সেন্টারে একমাস ট্রেনিং হলেও তারা বিদেশী ভাষা শিখতে পারেন না।

এ প্রসঙ্গে পরিচালক (বহির্গমন) আতাউর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, আসলে যেসব নারী কর্মী বিদেশে যাচ্ছেন এরা তো বাংলাই ঠিক ভাবে পড়তে পারে না। তাদের আরবি ভাষা শিখতে খুব কষ্ট হয়। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের জনবল কম, নতুবা এমন গাফিলতির কারণে অনেক ট্রেনিং সেন্টারের অধ্যক্ষকে আমি শাস্তিমূলক হিসাবে বদলি করতাম। কারণ, এভাবে শ্রমিক গিয়ে দেশে ফিরে এলে আমাদের বদনাম হয়।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top