মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারের সময়ই ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন- তিনি নির্বাচিত হলে দেশের দক্ষিণাংশের সীমান্তকে সুরক্ষিত করবেন। প্রাচীর নির্মাণ করবেন মেক্সিকো সীমান্তে। এই প্রাচীর হবে ‘দুর্ভেদ্য, দৃশ্যমান, উঁচু, শক্তিশালী এবং সুন্দর। যেমন কথা, তেমন কাজ। ক্ষমতা গ্রহণের এক সপ্তাহের মাথায় তিনি এ সংক্রান্ত নির্বাহী আদেশে সই করেন। তারই ধারাবাহিকতায় তহবিল সংগ্রহে গত সপ্তাহে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। আর এই জরুরি অবস্থা চ্যালেঞ্জ করে শুরু হয়েছে মামলা।
অবৈধ অভিবাসন রুখতে সীমান্তে ‘যেকোনো মূল্যে’ স্থায়ী প্রাচীর নির্মাণ ছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। কিন্তু এ কাজের জন্য তার চাহিদা অনুযায়ী ৫৭০ কোটি ডলার দিতে রাজি হচ্ছিল না মার্কিন কংগ্রেস। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসকে এড়িয়ে প্রাচীর নির্মাণের অর্থ বরাদ্দের জন্য গত শুক্রবার জাতীয় জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার নির্বাহী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সামরিক খাতের নির্মাণ প্রকল্পের ৩৬০ কোটি ডলার, মাদকবিরোধী প্রকল্পের ২৫০ কোটি ডলার এবং ট্রেজারি বিভাগের ৬০ কোটি ডলার প্রাচীর নির্মাণে বরাদ্দ দিতে পারবেন। তার সাথে কংগ্রেসের অনুমোদন করা ১৩৭ দশমিক পাঁচ কোটি ডলারের তহবিল যোগ হবে।
সব মিলিয়ে প্রাচীর নির্মাণের জন্য ট্রাম্পের হাতে আসবে প্রায় ৮০০ কোটি ডলার। তবে সীমান্তের দুই হাজার মাইলজুড়ে প্রাচীর নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় দুই হাজার ৩০০ কোটি ডলারের তুলনায় তা অনেক কম।
ট্রাম্পের জরুরি অবস্থা জারির সমালোচনা করে একে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ ও ‘বেআইনি সিদ্ধান্ত’ আখ্যায়িত করেছে বিরোধী দলে থাকা ডেমোক্র্যাটরা। ট্রাম্পকে ঠেকাতে সম্ভব সব কিছু করার ঘোষণা দিয়েছিল তারা। এর তিন দিনের মাথায় গত সোমবার দেশটির ১৬ রাজ্যের পক্ষ থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার আদালতে মামলা করা হয়। ট্রাম্পের জরুরি অবস্থা জারির আদেশের ওপর অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ চাওয়া হয়েছে মামলার আরজিতে।
রয়টার্স জানিয়েছে, ক্যালিফোর্নিয়ার নেতৃত্বে কলোরাডো, কানেকটিকাট, ডেলাওয়ার, হাওয়াই, ইলিনয়, মেইন, মেরিল্যান্ড, মিনেসোটা, নেভাডা, নিউ জার্সি, নিউ মেক্সিকো, নিউ ইয়র্ক, ওরিগন, ভার্জিনিয়া ও মিশিগান রয়েছে এ মামলার বাদিপক্ষে। এই রাজ্যগুলোর মধ্যে ম্যারিল্যান্ডের গভর্নর ল্যারি হোগান রিপাবলিকান পার্টির নেতা। বাকি গভর্নররা সবাই ডেমোক্র্যাটিক পার্টির।
ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হ্যাভিয়ার বেসেরা বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতার ‘অপব্যবহার’ ঠেকাতেই আমরা ট্রাম্পকে আদালতে নিচ্ছি। কংগ্রেসকে এড়িয়ে একক সিদ্ধান্তে তিনি যেভাবে করদাতাদের টাকা লুটে নিতে চাইছেন, তা বন্ধ করতেই আমরা আমাদের রাজ্যের মানুষের পক্ষে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। আমরা বিশ্বাস করি, প্রেসিডেন্টের দফতর কোনো রঙ্গমঞ্চ নয়।’
ট্রাম্প শুরু থেকেই এই দেয়ালের নির্মাণের খরচ মেক্সিকোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। বারবার বলছেন, মেক্সিকোকে এই খরচ দিতে বাধ্য করা হবে। কিন্তু মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট এনরিক পেনা নেইতো স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, তারা এ ধরনের কোনো খরচ দেবেন না।
টানা দুই মাস ধরে কংগ্রেসের সাথে মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের অর্থ বরাদ্দ চেয়ে লড়ছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ ডেমোক্র্যাটসহ তার নিজ দলেরও অনেকেই সেই অনুমতি না দেয়ায় বাজেটে ঢোকানো যাচ্ছিল না এ জন্য বরাদ্দের প্রয়োজনীয় অর্থ।
ট্রাম্পের শিশুসুলভ জেদ আর কংগ্রেসের না- এই দু’য়ের মধ্যে ঝুলে বার্ষিক বাজেট সই না হওয়ায় একবার যুক্তরাষ্ট্রকে ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা সময় (৩৫ দিন) আংশিক অচলাবস্থাও দেখতে হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসের বাজেট অফিস জানিয়েছে- ট্রাম্প প্রাচীর নির্মাণের জন্য যে অর্থ বরাদ্দের দাবি জনিয়েছেন তার চেয়ে দ্বিগুণ ক্ষতি হয়েছে এই অচলাবস্থায়। অচলাবস্থায় আমেরিকার জাতীয় অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ১১০০ কোটি ডলার। অন্য দিকে ট্রাম্প প্রাচীর নির্মাণের জন্য বরাদ্দ চেয়েছিলেন ৫৭০ কোটি ডলার।
প্রশাসনে ‘শাটডাউন’ বা অচলাবস্থার কারণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভাবমর্যাদা ধাক্কা খেয়েছে। জনমত সমীক্ষায় তার প্রতি সমর্থন ৩৪ শতাংশে নেমে আসে। রাশিয়াসংক্রান্ত তদন্তের কারণেও তিনি কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এবারের জরুরি অবস্থার কারণে তার জনপ্রিয়তা আরো কমবে এটাই ধারণা অনেকের। আবার যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে বলে মনে করে এফবিআই।
সব মিলিয়ে মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর গড়ার প্রতিশ্রুতি পালন করতে বিরোধী দলের সাথে চরম সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ফলে প্রশাসনে অচলাবস্থা কাটার কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে ঘরে-বাইরে আরো কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন ট্রাম্প। ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দুই বছর সংসদের উভয় কক্ষে নিজের রিপাবলিকান দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় নিজের ইচ্ছামতো অনেক পদক্ষেপ নিতে পেরেছেন তিনি। কিন্তু মিডটার্ম নির্বাচনে হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভে ডেমোক্র্যাটদের আধিপত্যের পর সেই সুবিধা হারিয়েছেন তিনি। ফলে শুরুতেই সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। তার জের ধরে বাজেট নিয়ে চরম অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।