অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাথে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির প্রধান সূচকগুলোর অধিকাংশেরই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি রাষ্ট্রায়ত্ত ১৭টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। গেল ডিসেম্বরে অর্ধবার্ষিক একটি মূল্যায়ন করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। গত সপ্তাহে এই মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
পৃথকভাবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রথম অর্ধবার্ষিক কার্যক্রম মূল্যায়নে প্রতিষ্ঠানগুলোর অগ্রগতি ‘সন্তোষজনক নয়’ বলে মন্তব্য করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান অধিকাংশ ক্ষেত্রে টার্গেট অনুযায়ী খেলাপি ঋণ ও অবলোপনকৃত ঋণ আদায় করতে পারেনি। এ পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রতিষ্ঠানের যেসব সূচকে অর্জন সন্তোষজনক নয়, সেসব সূচকে অর্থবছরের অবশিষ্ট সময়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক অবস্থার উন্নয়নে চার বছর ধরে অর্থবছরের শুরুতেই আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন সূচকে পৃথকভাবে তাদের অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সাথে বছরের শুরুতে পৃথকভাবে ‘বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি’ও স্বাক্ষর করা হয়। এ ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরেও ১৮টি প্রধান সূচকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাথে চুক্তি করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৭টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, শ্রেণীকৃত ঋণ ও অবলোপনকৃত ঋণ আদায় এবং এসএমই ঋণ বিতরণ পরিস্থিতি মোটামুটি সন্তোষজনক হলেও কৃষি ঋণ বিতরণ, অর্থ ঋণ অন্যান্য মামলা নিষ্পত্তিসহ কয়েকটি সূচকে সোনালী ব্যাংকের অর্জন সন্তোষজনক নয়।
একইভাবে রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক জনতার মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রেণিকৃত ঋণ হ্রাস, শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে নগদ আদায়, অবলোপনকৃত ঋণ হতে আদায়, অর্থঋণ ও অন্যান্য মামলা নিষ্পত্তি, ই-ফাইলিং ব্যবস্থা চালুকরণের ক্ষেত্রে ব্যাংকটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি।
প্রসঙ্গত এক বছরের ব্যবধানে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে গত বছর (২০১৮) ডিসেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৭ হাজার ৩০৪ কোটি ৭৭ লাখ। ফলে এক বছরেই জনতার খেলাপি ঋণ পরিমাণ বেড়েছে ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এই ঋণের পুরোটাই আবার দু’টি গ্রুপের কাছে, যাদের দুর্নীতির ও অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই ঋণ প্রদান করেছে।
জানা গেছে, কর্ম সম্পদান চুক্তি অনুযায়ী জনতা ব্যাংকের জন্য চলতি অর্থবছরের বেশ কয়েকটি টার্গেট নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য টার্গেটের মধ্যে রয়েছে, খেলাপি বা শ্রেণিকৃত ঋণ হতে নগদ আদায়, অবলোপনকৃত ঋণ হতে নগদ আদায়, কৃষি ঋণ বিতরণ, এসএমই ঋণ বিতরণ, অন্যান্য বিনিয়োগ, পরিচালন মুনাফা অর্জন, লোকসানি শাখার সংখ্যা হ্রাস, রিট মামলা নিষ্পত্তি, অর্থঋণ ও অন্যান্য মামলা নিষ্পত্তি, বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি, শাখাগুলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ইত্যাদি।
ডিসেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উল্লেখযোগ্য সূচকে জনতা ব্যাংক টার্গেট পূরণ করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন খেলাপি বা শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে চলতি বছরের জন্য আদায়ের টার্গেট দেয়া হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু ছয় মাসে ( জুলাই-ডিসেম্বর-২০১৮) আদায় করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ১৫৮ কোটি টাকা। টার্গেট অনুযায়ী এ সময়ে আদায় করার কথা ছিল ২৫০ কোটি টাকা। একইভাবে অবলোপনকৃত (ডেট রিট অফ) ঋণ হতে আদায় করার টার্গেট রয়েছে ১৫০ কোটি টাকা। এই হিসাব ছয় মাসে আদায় হওয়া উচিত ৭৫ কোটি টাকা। কিন্তু এই সময়ে জনতা ব্যাংক আদায় করেছে মাত্র ১৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।
প্রায় একইভাবে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা, শ্রেণিকৃত ঋণ ও অবলোপনকৃত ঋণ থেকে নগদ আদায়, অর্থ ঋণ ও অন্যান্য মামলা নিষ্পত্তিসহ বিভিন্ন সূচকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি অগ্রণী, রূপালী, বিডিবিএল ও বেসিক ব্যাংক।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল আট হাজার ৬১৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা। তবে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে কিছুটা সফলতার মুখ দেখছে ব্যাংকের বর্তমান ম্যানেজমেন্ট।
যেমন- অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাথে করা বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি ২০১৮-১৯ এর অর্ধবার্ষিক (জুলাই ১ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮) মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে এই ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ আদায়ের টার্গেট দেয়া হয়েছে ১৪০ কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৭৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে খেলাপি ঋণ আদায় এখন পর্যন্ত বেশি রয়েছে।
এ দিকে অন্যান্যের মধ্যে মূলধন সংরক্ষণের হার, ই-ফাইলিং পদ্ধতি বাস্তবায়ন, অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন, এটিএম বুথ চালুকরণ, শূন্য পদের বিপরীতে নিয়োগ প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোনো কোনো ব্যাংকের কার্যক্রমের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়।
বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মধ্যে কৃষিভিত্তিক শিল্প ঋণ বিতরণ, অন্যান্য কৃষি ও দারিদ্র্যবিমোচন ঋণ বিতরণ, শস্য ঋণ-দুগ্ধ উৎপাদন-প্রাণিসম্পদ-চিংড়ি ও মৎস্য চাষ ইত্যাদি খাতে ঋণ বিতরণ ও শ্রেণিকৃত ঋণ আদায় ইত্যাদি সূচকে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের অর্জন সন্তোষজনক নয়। অন্য দিকে ভূমিহীন বর্গাচাষিদের মধ্যে ঋণ বিতরণ, শ্রেণিকৃত ঋণ আদায়, রিট মামলার নিষ্পত্তির হার ইত্যাদি সূচকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা যায়, যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেসব সূচকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে বা অর্জন সন্তোষজনক, সেসব ক্ষেত্রে কার্যক্রমের অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বছরের বাদবাকি সময়ে এই সূচকগুলোতে অবশ্যই উন্নতি করতে হবে।