ভয়াবহ যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তান ও ভারত। আকাশযুদ্ধ তো হয়েই গেছে। পরমাণু যুদ্ধও হতে পারত। শক্তির বিচারে অনেক এগিয়ে থাকলেও অল্প কিছু সময়ের যুদ্ধে পাকিস্তানের কাছে ভারত দুটি বিমান হারিয়ে বেশ অস্বস্তিতেই পড়ে যায়। তাছাড়া একজন পাইলটও ধরা পড়ে পাকিস্তানের হাতে। ফলে প্রমাণিত হয়ে যায়, ভারতই সীমা লঙ্ঘনকারী। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধের হুঙ্কার থেকে সরে আসার পাকিস্তানের আহ্বানে সাড়া দেয় ভারত। বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায় উপমহাদেশ।
পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি সত্যিই ভয়ঙ্কর!
ইরান, চীন, ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে থেকে চিড়ে চ্যাপ্টা হওয়া পাকিস্তান নানা ধরনের নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে জটিল এক অঞ্চলে বাস করে। পরিচিত ৯টি পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোর একটি হলো পাকিস্তান। দেশটির পরমাণু অস্ত্র ভাণ্ডার ও মতবাদ অব্যাহতভাবে অনুমিত হুমকিগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে বিবর্তিত হয়েছে। কয়েক দশক ধরে পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ পাকিস্তান এখন তার নিজের মতো করে পরমাণু ত্রয়ী নির্মাণের মাধ্যমে তার পরমাণু অস্ত্র ভাণ্ডারকে আরো ক্ষিপ্র ও বিপর্যয়কর পাল্টা হামলার জন্য সক্ষম করার চেষ্টা করছে।
ভারতের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রথম দিনগুলোতে তথা ১৯৫০-এর দশকে পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচির সূচনা ঘটে। ১৯৬৫ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর একটি উক্তি বিখ্যাত হয়ে আছে : ‘ভারত যদি বোমা বানায়, তবে আমরা ঘাস-পাতা খেয়ে থাকব, এমনকি ক্ষুধার্ত থাকব, কিন্তু তবুও আমরা আমাদের নিজেদের বোমা বানাব।‘
ভারতের কাছে ১৯৭১ সালে পরাজিত হওয়ার পর (এর ফলে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে) কর্মসূচিটি আরো বেশি অগ্রাধিকার পায়। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, ভূখণ্ড হারানো অপমান, ভারতের পরমাণু বোমা তৈরির চেষ্টার চেয়েও বেশি করে, পাকিস্তানি পরমাণু কর্মসূচিকে ত্বরান্বিত করে। ভারত ১৯৭৪ সালের মে মাসে ‘স্মাইলিং বুদ্ধা’ কোডনামে তার প্রথম বোমা পরীক্ষা করে। এর মাধ্যমে দেশটি উপমহাদেশকে পরমাণু যুগের পথে নিয়ে যায়।
পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োজনীয় জ্বালানি হিসেবে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ও প্লুনোনিয়াম সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া শুরু করে। এ কাজে দেশটি বিশেষভাবে সহায়তা লাভ করে পাশ্চাত্যে কর্মরত মেটালুরজিস্ট এ কে খান। তিনি ১৯৭৫ সালে দেশে ফেরেন। তিনি সেন্টিফিউজ ডিজাইন ও সমৃদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ায় কয়েকটি দেশের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ শুরু করেন। ইউরোপিয়ান দেশগুলোও পাকিস্তানের কর্মসূচিটিকে সমর্থন করে এই ধারণায় যে পাকিস্তানের কর্মসূচিটি বেসামরিক প্রয়োজন পূরণের জন্য। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানের আসল উদ্দেশ্য পরিস্কার হয়ে যায়। এরপর পাশ্চাত্যের দেশগুলো সরে যায়। তবে পাকিস্তানের গোপন কর্মসূচি অব্যাহত থাকে।
পাকিস্তান তার প্রথম পরমাণু বোমাটি কবে সম্পন্ন করেছিল তা অস্পষ্ট। জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো দাবি করেন, তার বাবা তাকে বলেছিলেন যে প্রথম বোমাটি তৈরি করা হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। তবে পাকিস্তান পরমাণু জ্বালানি কমিশনের একজন সদস্য বলেছেন, তা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। আর সত্যিকার পরীক্ষা স্থগিত রেখে ‘কোল্ড টেস্ট’ করা হয় ১৯৮৩ সালে।
বেনজির ভুট্টো দাবি করেছেন, পাকিস্তানের বোমাগুলো ১৯৯৮ সালের আগে পর্যন্ত সংযোজনহীন অবস্থায় ছিল। ওই বছরই ভারত তিন দিনের ব্যবধানে ছয়টি বোমা পরীক্ষা করে। তিন সপ্তাহ পর পাকিস্তান একই ধরনের দ্রুত পরীক্ষার পথ বেছে নেয়। তারা এক দিনে ৫টি বোমা পরীক্ষা করে, ৬ষ্ট বোমাটি পরীক্ষা করে তিন দিন পর। প্রথম বোমাটি ছিল আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ কিলোটনের। দ্বিতীয়টি ছিল ১২ কিলোটনের।
পাকিস্তানের মতো উত্তর কোরিয়ায় ইউরেনিয়ামভিত্তিক বোমা তৈরি নিয়ে কাজ করছিল। এ কিউ খানের মাধ্যমে পাকিস্তান যোগাযোগ করেছিল উত্তর কোরিয়ার সাথে। অনেকে মনে করে, পাকিস্তান যে ষষ্ট বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল, তা ছিল উত্তর কোরিয়ার বোমা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রয়োজনের আলোকে পাকিস্তানের পরমাণু মজুত ধীরে ধীরে বাড়ছে। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের কাছে ছিল ৫ থেকে ২৫টি বোমা। বর্তমানে পাকিস্তানের কাছে আছে ১১০ থেকে ১৩০টি বোমা। ২০১৫ সালে কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস অ্যান্ড স্টিমসন সেন্টার জানায়, পাকিস্তানের বর্তমানে বছরে ২৫টি বোমা বানানোর সামর্থ্য রয়েছে। দেশটি অল্প সময়ের মধ্যেই তৃতীয় বৃহত্তম পরমাণু অস্ত্রধারী দেশে পরিণত হতে পারে। তবে অনেকে মনে করেন, পাকিস্তান অদূর ভবিষ্যতে আরো ৪০-৫০টি পরমাণু বোমা তৈরি করতে পারে।
পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রগুলো সামরিক বাহিনীর স্ট্র্যাটেজিক প্লানস ডিভিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকা ও তালেবানের নিয়ন্ত্রণ থেকে দূরে মূলত পাঞ্জাব প্রদেশেই এগুলো রাখা হয়েছে। এই অস্ত্র পাহারায় থাকে প্রায় ১০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ও গোয়েন্দা। পাকিস্তান দাবি করে থাকে, একেবারে শেষ মুহূর্তে কোড ব্যবহার করে বোমাগুলো হামলার জন্য প্রস্তুত করা হবে।
ভারতের কাছ থেকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক যেকোনো হুমকি প্রতিরোধ করার মতবাদে পাকিস্তানের পরমাণু প্রণীত। প্রতিবেশী ভারত ও চীনের মতো প্রথমে ব্যবহার নয়, এমন নীতি নেই পাকিস্তানের। প্রচলিত বাহিনীতে অনেক বেশি শক্তিশালী ভারতের আক্রমণের মোকাবিলায় পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের অধিকার আছে বলে দেশটি মনে করে।
পাকিস্তানের এখন স্থল, আকাশ ও সাগর থেকে পরমাণু অস্ত্র নির্মাণের সামর্থ্য রয়েছে। আমেরিকার নির্মিত এফ-১৬এ ও ফ্রান্সের মিরেজ জঙ্গি বিমানকে সংস্কার করে এগুলোকে পরমাণু বোমা ব্যবহারোপযোগী করে তুলেছে পাকিস্তান। এসব বিমান ভারতের শহর ও অন্যান্য এলাকায় বোমা হামলা চালাতে পারে।
স্থলভিত্তিক হামলা করা যায় ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে। চীন ও উত্তর কোরিয়ার নক্সায় পাকিস্তান তার ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থাকে উন্নত করেছে। হাতফ সিরিজের ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে হাতফ-৩ (১৮০ মাইল), হাতফ ৪ (৪৬৬ মাইল), হাতফ ৫ (৭৬৬ মাইল)। আর হাতফ ৬-এর পাল্লা ১২৪২ মাইল। শাহিন ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ১৭০৮ মাইল। এগুলো ভারতের নিকোবর ও আন্দামানেও হামলা চালাতে পারবে।
পাকিস্তানের পরমাণু শক্তি ক্রুস ক্ষেপণাস্ত্রের বাবুর শ্রেণিভুক্ত। সর্বশেষ সংস্করণ বাবুর ২ সর্বাধুনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। এর পাল্লা ৪৩৪ মাইল।
এই ক্ষেপণাস্ত্র স্থল ও সাবমেরিনেও ব্যবহার করা যায়। গত জানুয়ারিতে পাকিস্তান বাবুর ৩ পরীক্ষা করেছে। এটি পাকিস্তানের পরমাণু সরবরাহ ব্যবস্থাকে সবচেয়ে টেকসই মাত্রা দিয়েছে।
পাকিস্তান কেবল ভয় দেখানোর জন্য নয়, পরমাণু যুদ্ধ করার জন্যও তার পরমাণু বোমার শক্তি সঞ্চয় করেছে। পাকিস্তান ও ভারত স্পষ্টভাবেই এমন এক পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে, যা স্নায়ু যুদ্ধের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। আর এ কারণে উপমহাদেশে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি খুবই প্রয়োজনীয়।