উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দুশ্চিন্তায় আ’লীগ

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে অনুষ্ঠিত দলের মনোনয়ন বোর্ডের সভা থেকে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম নুরুল আমিন মাস্টার। প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরযুক্ত মনোনয়ন ফরমও তার হাতে তুলে দেয়া হয় কেন্দ্র থেকে; কিন্তু এক দিনপরই উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক রেবেকা বেগমকেও নৌকা প্রতীক দিয়ে আরেকটি মনোনয়ন ফরম ইস্যু করা হয়। দুইজনই দলীয় প্রার্থী হিসেবে সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে মনোনয়ন ফরম জমা দেন এবং তাদের দুইজনকেই বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে রিটার্নিং অফিস। ফলে এখানে নৌকার আসল প্রার্থী কে তা নিয়ে অন্ধকারে রয়েছেন নেতাকর্মীরা। তবে তাদের বাইরেও বিদ্রোহী হিসেবে আরো সাতজন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন এই উপজেলায়। এ ছাড়া লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে আরো পাঁচজন এবং রামগতি ও রামগঞ্জে দুইজন ও রায়পুরে একজন করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলায় নৌকার প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন আরো চারজন। শুধু তা-ই নয়, দেশের প্রায় সব জেলাতেই এ রকম অবস্থা বিরাজ করছে। উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গৃহবিবাদে পড়ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপি জোট এ নির্বাচন বর্জন করায় তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এখন নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হুমকি-ধমকি, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতেও লিপ্ত হচ্ছে তারা। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে মাঝে মধ্যে।

সর্বশেষ জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে প্রতিপক্ষের গুলিতে আব্দুল খালেক নামে এক যুবলীগ নেতা নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো অনেকে। বুধবার রাত সাড়ে ১১টায় উপজেলার চুকাইবাড়ি এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী আবুল কালাম আজাদের সমর্থকেরা নির্বাচনী প্রচারণা শেষে চুকাইবাড়ি এলাকায় চা পান করছিলেন। এ সময় দলের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী সোলাইমান হোসেনের সমর্থকেরা তাদের ওপর হামলা ও গুলি বর্ষণ করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে দেওয়ানগঞ্জ এ কে মেমোরিয়াল কলেজের সাবেক জিএস যুবলীগ নেতা আব্দুল খালেক ঘটনাস্থলেই মারা যান।
এর আগে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মাদারীপুর সদরে ক্ষমতাসীনদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে সাহেবালী মাতুব্বর নামে একজন নিহত হন। এ সময় আহত হয়েছেন আরো পাঁচজন।

আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানায়, আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে অংশ নিলেও প্রায় সব উপজেলাতেই চেয়ারম্যান পদে বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে। দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড ইতোমধ্যে তিন ধাপে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে; কিন্তু আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা দলের এ সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে অনেকেই বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এ সংখ্যা কয়েক শ’ হতে পারে। আর ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থিতা উন্মুক্ত থাকায় ওই পদে আরো বেশিসংখ্যক নেতাকর্মী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সরকারদলীয় প্রার্থী ছাড়া অন্য দলের তেমন কোনো প্রার্থী না থাকায় এবার দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধেই লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে নৌকার মাঝিদের। আর নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে মাঠপর্যায়ে দলীয় বিরোধও প্রকাশ্য হয়ে উঠছে। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড বেশ উদ্বিগ্ন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে একজন, লাখাই উপজেলায়, দুইজন, চুনারুঘাটে একজন, বাহুবলে দুইজন, নবীগঞ্জে একজন, আজমিরীগঞ্জে একজন, বানিয়াচংয়ে একজন ও মাধবপুরে একজন করে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন।
লালমনিরহাট সদর উপজেলায় একজন, আদিতমারীতে একজন, কালীগঞ্জে দুইজন, হাতীবান্ধায় ছয়জন করে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে একজন, তানোরে দুইজন, মোহনপুরে একজন, বাগমারায় দুইজন, দুর্গাপুরে দুইজন, চারঘাটে একজন, বাঘা উপজেলায় একজন করে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন।

নাটোর সদরে একজন, সিংড়ায় দুইজন, বাগাতিপাড়ায় দুইজন, লালপুরে একজন, গুরুদাসপুরে দুইজন করে বিদ্রোহী মাঠে রয়েছেন।
এভাবে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে মনোনয়ন দেয়া দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রায় সব উপজেলাতেই বিদ্রোহী প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। কেন্দ্র এবং স্থানীয় নানা মাধ্যমে চেষ্টা-তদবির করা হলেও মাঠ ছাড়ছেন না বিদ্রোহীরা। এতে তৃণমূল আওয়ামী লীগে চরম বিভক্তি দেখা দিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের তিন নেতা আলাপকালে বলেন, এবারের উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ খানিকটা বিপাকে পড়েছে। বিএনপি জোট নির্বাচন বর্জন করায় ঢাকা সিটির মতো উপজেলা নির্বাচনও প্রাণ হারিয়েছে। সে জন্য মাঠপর্যায়ে একটু নির্বাচনী আমেজ আনতে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। তবে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী ঠিক করে দিলেও নির্বাচনী উৎসব আনতে বিদ্রোহীদের ব্যাপারে তেমন কোনো কঠোর অবস্থান নিতে পারছে না দল। কারণ, প্রার্থী যত বেশি হবে নির্বাচনও তত জমজমাট হবে। আর বেশি প্রার্থীর কারণে বেশিসংখ্যক ভোটারও ভোটকেন্দ্রে যাবে। তবে নির্বাচনী উৎসব আনতে গিয়ে তৃণমূলপর্যায়ে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে, যা দলের জন্য শুভ নয়।

এ ব্যাপারে লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মিয়া মোহাম্মদ গোলাম ফারুক পিংকু গতকাল সন্ধ্যায় নয়া দিগন্তকে বলেন, লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে দলীয় প্রার্থীর ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে তা নতুন নয়। দল যেকোনো মুহূর্তে প্রার্থী পরিবর্তন করতে পারে। এর আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও রায়পুরের একটি ইউনিয়নে শেষ মুহূর্তে প্রার্থী বদল করে কেন্দ্র থেকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। এটিই ছিল চূড়ান্ত। আশা করি, দুই-এক দিনের মধ্যেই দলীয় প্রার্থী নিয়ে এ বিভ্রান্তির অবসান হয়ে যাবে। আর লক্ষ্মীপুরের কোনো উপজেলাতেই শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী থাকবে না। দল যাকে মনোনয়ন দিয়েছে স্থানীয় নেতাকর্মীরা তার পক্ষেই ঐক্যবদ্ধ থাকবে। আমরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবো।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘উপজেলা নিয়ে তৃণমূলে ছোটখাটো বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। এত বড় দলে এইটুকু প্রতিযোগিতা তো থাকবেই। আমরা মনে করি যারা প্রার্থী হয়েছে, তাদের সবাই চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্য। তবুও বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে একজনকে মনোনয়ন দিয়েছে মনোনয়ন বোর্ড। বিষয়টি সবাইকে মানতে হবে। শেষ পর্যন্ত মাঠ নেতাকর্মীদের নৌকার পক্ষেই কাজ করতে হবে।’

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top