ইংরেজি ভাষাকে ঘৃণা নয়

ইংরেজি ভাষার উন্নয়ন ঘটেছে ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষের সাধারণ উদ্যমে। ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষ তাদের ভাষার উন্নয়নের জন্য কোনো একাডেমি স্থাপনের কথা অনুভব করেনি। যেমন আমরা অনুভব করেছি বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার। তবুও ইংরেজি ভাষা হয়ে উঠেছে বর্তমান বিশ্বের প্রধান ভাষা। কেন, কী কারণে এটা হতে পারল, সে ভাষার অনুশীলন হতে পারে আমাদের জন্য শিক্ষাপ্রদ। আমরা এখন মনে করছি, বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য ইংরেজি ভাষা হয়ে উঠেছে প্রতিবন্ধক। তাই ইংরেজি ভাষাকে বর্জন করতে হবে। কিন্তু অতীতে আমরা তা ভাবিনি। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজি গদ্যের অনুসরণ করে বাংলা গদ্যের হতে পেরেছে বিপুল প্রকর্ষ। ইংরেজি ভাষা বাংলা ভাষার ক্ষতি করেনি। ইংরেজ হলহেড সাহেব প্রথম সৃষ্টি করেন বাংলা অক্ষর ছাপার জন্য সিসক ধাতুর অক্ষর। বাংলা ছাপার অক্ষরে উঠতে পারে ব্রিটিশ শাসনামলে।

বিরাট ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছে। কিন্তু এর ফলে ইংরেজি ভাষা যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা মোটেও নয়। বর্তমানে ইংরেজি ভাষার উন্নয়ন ঘটছে যুক্তরাষ্ট্রের কারণে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশকেরা জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে, যে পরিমাণ গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারছেন, অন্য দেশের প্রকাশকেরা তা পারছেন না। অন্য দিকে, ইংরেজি ভাষায় লেখা বইয়ের পাঠকের সংখ্যা হলো সবচেয়ে বেশি। এ কারণে ইংরেজি ভাষায় লেখা বইয়ের চাহিদা ও সরবরাহ উভয়ই হতে পারছে বেশি। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বিজ্ঞান ও কৃতকৌশলে সর্বাপেক্ষা উন্নত দেশ। তাই বিজ্ঞান ও কৃতকৌশলের সাথে হালনাগাদ থাকতে হলে পড়তে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত ইংরেজি ভাষায় লেখা বই ও পত্রিকা, আর এর জন্য সব দেশের ছাত্র ও গবেষকদের ইংরেজি ভাষা পড়ে বোঝার মতো জ্ঞান (Reading Knowledge) থাকতে হয়। ইংরেজি ভাষায় যে বিশারদ হতে হবে, এমন নয়। আমরা ইংরেজিভাষী দেশ না হলেও ইংরেজি জানা দেশ। এই ভাষা আমরা যেকোনো বিদেশী ভাষার চেয়ে অনেক সহজে শিখতে পারি। আমরা আমাদের এই ঐতিহ্যকে উগ্র বাংলা ভাষাভাষী জাতীয়তার ঘোরে পরিত্যাগ করতে চাইলে ভুল পথে হাঁটা হবে। এতে মার্কিন ‘সাম্রাজ্যবাদের’ কোনো ক্ষতি হবে না। ক্ষতি হবে আমাদেরই।

সুলতানি ও মুঘল বাদশাহী আমলে আমাদের প্রশাসন চলেছে ফারসি ভাষার মাধ্যমে। আদালতের ভাষাও ছিল ফারসি। ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৯৩৮ সালে আদালতে ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি ভাষার প্রবর্তন করে। অর্থাৎ তারা এই দেশের নিয়ন্ত্রণ লাভের পরেই যে আদালতের ভাষা ইংরেজি করেছিল, তা নয়। ইংরেজির প্রবর্তন করেছিল বেশ কিছুটা ধীরস্থিরভাবে। যে ইংরেজি ভাষায় আমাদের হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে রায় ও আদেশ লেখা হচ্ছে, তাকে বলে আইনের ইংরেজি। এই আইনের ইংরেজি বেশ পুরনো। এই ইংরেজি ভাষার আছে আইন অভিধান। অনেক জায়গায় নির্দিষ্টভাবে বলে দেয়া আছে কোন ইংরেজি শব্দের কী অর্থ ধরতে হবে। কিন্তু বাংলা ভাষায় এখনো কোনো আইনের অভিধান রচিত হয়নি। তাই বাংলা ভাষায় আদালতের কোনো রায় বা আদেশ লিখলে তার ব্যাখ্যা নিয়ে দেখা দিতে পারে যথেষ্ট গোলযোগ। আর আদেশ তাই হতে পারে অনেক ক্ষেত্রেই অকার্যকর।

ব্রিটিশ শাসনামলে ভাষা নিয়ে প্রথম সঙ্ঘাত সৃষ্টি হয়েছিল তদানীন্তন মাদ্রাজ প্রদেশে। ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত মাদ্রাজ প্রদেশে প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচনে জয়ী হয় কংগ্রেস দল। কংগ্রেস মন্ত্রিসভা আইন করে, মাদ্রাজের স্কুলে হিন্দি শেখাতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে। কিন্তু মাদ্রাজের তামিল ভাষাভাষীরা এই আইন মানতে চান না। তারা এই আইন তুল দেয়ার জন্য শুরু করেন প্রচণ্ড আন্দোলন। পুলিশ একটি আন্দোলনরত মিছিলের ওপর গুলি চালায়। যাতে মারা যান দুই ব্যক্তি। ১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযযুদ্ধ। কংগ্রেস মন্ত্রিসভা এ সময় পদত্যাগ করে। কারণ, কংগ্রেস চায় না ব্রিটিশ সরকারের সাথে যুদ্ধে সহযোগী করতে। কংগ্রেস মাদ্রাজ পরিষদে আর না থাকলে মাদ্রাজে জারি হয় গভর্নরের শাসন। গভর্নর মাদ্রাজের স্কুলে বাধ্যতামূলকভাবে হিন্দি শিক্ষার আইন বাতিল করে দেন। ভারতের সংবিধানে বলা হয়েছিল ১৯৬৫ সালের মধ্যে হিন্দিকে করতে হবে রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় পরিবারভুক্ত ভাষাভাষী লোক এতে অসন্তুষ্ট হন। বিশেষ করে, মাদ্রাজ প্রদেশের তামিলভাষীরা। তারা প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু করেন। এ ধরনের একটি বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে কমপক্ষে মারা যান ৬০ ব্যক্তি। আর আহত হন অনেকেই। এরপর ভারত সরকার বাধ্য হন একমাত্র হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করে থাকে। ভারতের লোকসভায় প্রস্তাব পাস হয় যে, ইংরেজি ভাষাতেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য চলবে ভারত সরকারের সরকারি কার্যকলাপ, অহিন্দিভাষী অঙ্গরাজ্যগুলোর সাথে। এই সাথে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ভাষাকে রেখে দেয়া হয় ইংরেজি। আমরা জানি না, ভারতে ভাষা আন্দোলন কতটা জোরালো হয়েছিল। ঢাকায় যেভাবে গুলি চলেছিল, তার চেয়ে অনেক মারাত্মক ও ভয়াবহভাবে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল মাদ্রাজ প্রদেশের একটি শহরে। তামিলভাষীরা পরে তাদের প্রদেশের নাম আর মাদ্রাজ রাখেন না, তারা ১৯৬৯ সালে তাদের প্রদেশের নামকরণ করেন তামিলনাড়ু। তামিল ভাষায় ‘নাড়ু’ মানে হলো দেশ। আর মাদ্রাজ শহরের নাম বদলিয়ে রাখেন চেন্নাই। মাদ্রাজ নামটা এসেছিল পর্তুগিজদের কাছ থেকে।

সাবেক পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন একটা ব্যর্থ আন্দোলন ছিল না। ১৯৫৪ সালের ১৯ এপ্রিল পাকিস্তানের গণপরিষদ উর্দু ও বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে (১৯৫৮) চেষ্টা করেন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে। কিন্তু তিনি সেটা করতে পারেননি। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে থেকে যায় বাংলা ও উর্দু। ১৯৬২ সালের মে মাসে ঢাকায় স্থাপিত হয় কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড, যা থেকে প্রথম সরকারি খরচে বাংলা ভাষায় ছাপা হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় অনেক গ্রন্থ। জানি না, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কেন এই উন্নয়ন বোর্ড তুলে দেয়া হলো। আমি মনে করি, বাংলাদেশে আবার এ ধরনের সংস্থা স্থাপিত হওয়া উচিত।

ব্রিটিশ শাসনামলে কেবল কলেজের পাঠ্যসূচি নয়, স্কুলের পাঠ্যসূচিও নিয়ন্ত্রণ করত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯১৭-১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন বসায়। বিলাতের লিডস্ ইউনিভার্সিটির ভাইস স্যান্সেলর ছিলেন ড. স্যাডলার। তাকেই করা হয় এই কমিশনের সভাপতি। তাই এই কমিশনকে স্যাডলার কমিশনও বলে। স্যাডলার কমিশন বলে যে, স্কুল পর্যায়ে শিক্ষা প্রদান করা উচিত মাতৃভাষায়। অর্থাৎ বাংলাভাষার মাধ্যমে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্যাডলর কমিশনের পরামর্শ অনুসারে স্কুলে বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এ সময় স্কুলের শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজনীয় পুস্তকাদি বাংলা ভাষায় প্রণীত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৪০ সালে বাংলা ভাষার মাধ্যমে প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষা নেয়। কিন্তু কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম থাকে ইংরেজি ভাষা। আমরা উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করেছি বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ হওয়ার পর। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তকের অভাব বিশেষভাবেই বিদ্যমান। আমাদের উচিত হবে ইংরেজি ভাষা থেকে বিভিন্ন বিষয়ে পুস্তকের বাংলা অনুবাদ করা। যাতে পাঠ্যপুস্তকের এই ঘাটতি সহজেই পূর্ণ হতে পারে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেক মিথ্যা কাহিনী রচিত হতে পারছে। যার অপনয়ন হওয়া দরকার। ভাষাতাত্ত্বিক ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ব্রিটিশ শাসনামলে বলেছিলেন, ভাবি স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা হতে হবে উর্দু নয়, হিন্দি। আর এই হিন্দি লিখতে হবে রোমান বর্ণমালায়। তিনি বলেন যে, বাংলা ভাষাকেও রোমান বর্ণমালায় লিখতে হবে। তা হলে বাংলাভাষী ছাত্রদের পক্ষে হিন্দি শিখতে অসুবিধা হবে না। এখন সাধারণত প্রচার করা হয় যে, পাকিস্তান আমলে আরবি ফারসি অক্ষরে বাংলা লেখার প্রস্তাব উঠেছিল। কিন্তু কবি আলাওল তার কাব্যগ্রন্থসমূহ লিখেছেন আরবি-ফারসি অক্ষরে। বাংলা অক্ষরে নয়। একসময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাংলা লেখা হতো আরবি-ফারসি অক্ষরে। ভাষাতাত্ত্বিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একসময় প্রস্তাব করেছিলেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত আরবি। কারণ, আরবি হলো কুরআনের ভাষা। তিনি এক পর্যায়ে উর্দু উন্নয়ন বোর্ডেও গ্রহণ করেছিলেন মহাপরিচালকের পদ। বাংলা ভাষার দু’জন দিকপাল গবেষক বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন বলে মনে হয় না। ১৯৪৭ সালে ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় তমদ্দুন মজলিশ নামে একটি সংগঠন গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এই সংগঠনটির পক্ষ থেকে ‘বাংলা না উর্দু’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এটাই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকা। এরকম পুস্তিকা এর আগে আর কোনো সংগঠন প্রকাশ করেনি। এই সংগঠনটি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নিয়েছিল খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। অথচ সংগঠনটির নাম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে লিখিত বিভিন্ন বইতে এখন আর সেভাবে নেয়া হয় না। কারণ এই প্রতিষ্ঠানটি ছিল ইসলামপন্থী।

অধ্যাপক গোলাম আযম (১৯২২-২০১৪) ১৯৫০ সালে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের জিএস। তিনি তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে ঢাকায় বাংলা ভাষার দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি পাঠ করে শোনান। যাতে বলা হয়েছিল কেন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা উচিত হবে। ঢাকার বিখ্যাত নবাববাড়ির ভাষা ছিল উর্দু। পুরনো ঢাকার মুসলমানেরা বলতেন এক ধরনের বিকৃত উর্দু। ঢাকার মুসলমানেরা ছিলেন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে। গোলাম আযম ও তার সাথীরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে এদের মধ্যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা কেন করা হবে, সেই সম্বন্ধে প্রচার কার্য চালান। ১৯৫২ সালে গোলাম আযম চাকরি করতেন রংপুরে কারমাইকেল কলেজে। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন প্রভাষক। ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি চলার পর রংপুরে যে ভাষা আন্দোলন হয়, তাতে তিনি দেন নেতৃত্ব। এই নেতৃত্বদানের কারণে তাকে যেতে হয় জেলে এবং হারাকে হয় চাকরি। ভাষা আন্দোলনে গোলাম আযমের এই বিরাট অবদানকে রাজনৈতিক কারণে দেয়া হচ্ছে না কোনো স্বীকৃতি। বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা মুহাম্মদ তোয়াহা (১৯২২-১৯৮৭) গোলাম আযম সম্পর্কে বলেছেন, তিনি ছিলেন একজন চরিত্রবান ও আদর্শ প্রকৃতির ছাত্র। তিনি না হলে পুরান ঢাকায় ভাষা আন্দোলন করা যেত না। তোয়াহা ও গোলাম আযম ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সময় অন্তরঙ্গ সাথী।

ব্রিটিশ শাসনামলে মৌলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) কলকাতা থেকে বাংলায় প্রকাশ করেন ‘আজাদ’ নামে একটি দৈনিক বাংলা পত্রিকা। এই পত্রিকাটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রেখেছে বিশেষ অবদান। একসময় আজাদ হয়ে উঠেছিল বাংলাভাষী মুসলমানের একমাত্র মুখপত্র। আকরম খাঁ ছিলেন পীরালি মুসলমান। তিনি সম্পর্কে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের জ্ঞাতি ভাই। কেননা, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পীরালি ব্রাহ্মণ। পাকিস্তান হওয়ার পর আজাদ পত্রিকা কলকাতা থেকে উঠে আসে ঢাকায়। আজাদ পত্রিকা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সমর্থন করে। ফলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পেতে পারে বিশেষ জনসমর্থন। অন্যদিকে জহুর হোসেন ছিলেন সে সময় একজন নামকরা কমিউনিস্ট। তিনি সম্পর্কে ছিলেন নূরুল আমীন (১৮৯৩-১৯৭৪)-এর ভাগিনা। তিনি তার মামার টাকায় ঢাকায় বের করেন ‘সংবাদ’ নামক দৈনিক পত্রিকা। ২১ শে ফেব্রুয়ারি গুলি চলার পর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে মিথ্যা খবর। ক্ষুব্ধ জনতা সংবাদ অফিসে অগ্নি সংযোগ করে। সংবাদ-এ মিথ্যা খবর ছাপা হওয়ার কারণ, নূরুল আমীনকে বাঁচাবার চেষ্টা। আর লোককে বোঝান যে, গুলি চালানোর দায়দায়িত্ব ঠিক নূরুল আমীনের নয়। এ সময় বাংলাদেশের গভর্নর ছিলেন ফিরোজ খান নুন, যিনি ছিলেন পাঞ্জাবি। আর তার স্ত্রী ছিলেন একজন ইংরেজ মহিলা। বাঙালি মুসলমান সম্পর্কে ফিরোজ খান নুনের স্ত্রী এ সময় করেছিলেন একটা খুবই অশিষ্ট মন্তব্য।

বহু বামপন্থী এখন বলেন যে, তাদের জন্যই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সফল হতে পেরেছিল। কিন্তু এ কথাও যে সত্য, তা বলা চলে না। এ সময় পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান সেক্রেটারি ছিলেন সাজ্জাদ জহির। তিনি ছিলেন বিলাতে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত একজন নামকরা কমিউনিস্ট নেতা। তার পৈতৃক নিবাস ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশে। তিনি ছিলেন উর্দুভাষী। পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি চলে আসেন করাচি এবং হন পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান সেক্রেটারি। তিনি বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে হবে কেবলই উর্দু। কেননা পাকিস্তানের শ্রমজীবীরা বাংলাভাষা বোঝে না, তারা উর্দু বোঝে। আর শ্রমজীবী মানুষদের নিয়েই করতে হবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। বাংলাদেশের বেশ কিছু কমিউনিস্ট নেতা তার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। এদের মধ্যে একজন হলেন তোয়াহা। ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা যথেষ্ট স্মরণীয় হয়েই আছে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯২-১৯৬৩) এবং খাজা নাজিমুদ্দিন (১৮৯৪-১৯৬৪) ছিলেন মুসলিম লীগের দু’জন বিখ্যাত নেতা। খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন ঢাকা শহরের বাসিন্দা। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী ছিলেন কলকাতার। পাকিস্তান হওয়ার পর সোহরাওয়ার্দী পড়েন রাজনৈতিক অসুবিধায়। কেননা, কলকাতা শহর পাকিস্তানে পড়ে না। সোহরাওয়ার্দীদের আদি নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের মেদেনীপুর। মেদেনীপুর পড়ে ভারতে। ১৯৪৯ সালে সোহরাওয়ার্দী ভারত থেকে যান পাকিস্তানের করাচিতে। ১৯৫১ সালের ২৪ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী লীগ’। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় চলেছিল গুলি। ১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদ শহরের এক জনসভায় সোহরাওয়ার্দী বলেন, যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তদানুসারে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। অন্যদিকে খাজা নাজিমুদ্দিন প্রথমে হন পূর্ব বাংলার আইন পরিষদের প্রধানমন্ত্রী। এরপর তিনি হন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল (১৯৪৮-১৯৫১)। তারপর খাজা নাজিমুদ্দিন গণ-পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (১৯৫১-১৯৫৩)। ১৯৫০ সালে ঢাকায় এসে খাজা নাজিমুদ্দিন নতুন করে বলেছিলেন, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। যা ঘটায় নতুন করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। উল্লেখ্য, সোহরাওয়ার্দী ও নাজিমুদ্দিন উভয়ই খুব সুন্দর ইংরেজি বলতেন। দু’জনেই ছিলেন বিলাত ফেরত নেতা। কিন্তু এদের কারও মাতৃভাষাই বাংলা ছিল না। এদের পরিবারে চলত উর্দু ভাষা। যদিও এরা দু’জনেই ছিলেন বাংলা প্রদেশের নেতা।

যাকে বলে ভাষাসৈনিক, আমি তা ছিলাম না। সে দাবিও আমি করি না। তবে এই আন্দোলন থেকে খুব যে সরে ছিলাম, তাও বলা ঠিক হবে না। ভাষা আন্দোলনে আমিও আন্দোলিত হয়েছিলাম। এই স্তম্ভে আমি যা বললাম, সেটা আমার স্মৃতি থেকে। তথ্যগত কিছু ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে।

লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top