বাংলাদেশের শিক্ষা নগরী ময়মনসিংহ এখন দেশের ৪র্থ বৃহত্তম শহর

মো. আব্দুল কাইয়ুম : ময়মনসিংহ বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম শহর। বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এটি ময়মনসিংহ জেলার প্রায় কেন্দ্রভাগে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত। নদীর তীর জুড়ে থাকা শহর-রক্ষাকারী বাঁধের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে নিয়ে গড়ে উঠেছে ময়মনসিংহ পার্ক যা শহরবাসীর মূল বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত। বর্তমানে পার্কের অনেক দৃশ্যমান উন্নয়ন করা হয়েছে। ময়মনসিংহ নগরীতে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ,মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ জিলা স্কুল, ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ, বিদ্যাময়ী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রভৃতি; তাই ময়মনসিংহ শিক্ষা নগরী হিসেবে পরিচিত। এটি বাংলাদেশের অষ্টম বিভাগীয় শহর। এছাড়াও এটি দেশের কনিষ্ঠতম সিটি কর্পোরেশন।

ভৌগোলিক পরিচিতি

ময়মনসিংহ শহরের নবনির্মিত জিরো পয়েন্ট নির্দেশক স্থাপনা। নির্মাণকাল – ২০১১ খ্রিস্টাব্দ

ময়মনসিংহ জেলা ২৪°০২’০৩” থেকে ২৫°২৫’৫৬” উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°৩৯’০০” থেকে ৯১°১৫’৩৫” পূর্ব দ্রাঘিমাংশের অবস্থিত। সর্বশেষ ভূমি রেকর্ড ও জরিপ (১৯৭১) অনুযায়ী এটি ৫,০৩৯.৭৬ বর্গ মাইল (১৩,০৫২.৯২ বর্গ কিলোমিটার) ব্যাপী একটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত।

প্রকৃত শহর এলাকা, মিউনিসিপাল এলাকার চেয়ে বড়। ময়মনসিংহ শহর তার উত্তর বরাবর প্রবাহিত পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী দ্বারা পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত।

নামকরণ

ময়মনসিংহ জেলার নামকরণ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে ভিন্ন মত প্রচলিত আছে। আর ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার পুত্র সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ’র জন্য এ অঞ্চলে একটি নতুন রাজ্য গঠন করেছিলেন, সেই থেকেই নসরতশাহী বা নাসিরাবাদ নামের সৃষ্টি। মুসলিম যুগের উৎস হিসেবে নাসিরাবাদ নামটিও আজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোথাও উল্লেখ করা হচ্ছে না। ১৭৭৯-তে প্রকাশিত রেনেল এর ম্যাপে মোমেসিং নামটি বর্তমান ‘ময়মনসিংহ’ অঞ্চলকেই নির্দেশ করে। তার আগে আইন-ই-আকবরীতে ‘মিহমানশাহী’ এবং ‘মনমনিসিংহ’ সরকার বাজুহার পরগনা হিসাবে লিখিত আছে; যা বর্তমান ময়মনসিংহকেই ধরা যায়। এসব বিবেচনায় বলা যায় সম্রাট আকবরের রাজত্ব কালের পূর্ব থেকেই ময়মনসিংহ নামটি প্রচলিত ছিলো। ব্রিটিশ আমলে জেলা পত্তন কালে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সমৃদ্ধ জমিদারগণ সরকারের কাছে জেলার নাম ‘ময়মনসিংহ’ রাখার আবেদন করলে সরকার তা গ্রহণ করে নেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] আবার অনেকে মনে করেন, ময়মনসিংহ নামকরণ করা হয় সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি মান সিংহের নাম অনুসারে। সেনাপতি মান সিংহকে সম্রাট আকবর এ অঞ্চলে পাঠান বার ভূইয়ার প্রধান ঈশা খাঁকে পরাজিত করার জন্য। সেনাপতি মান সিংহ ময়মনসিংহে ঘাঁটি স্থাপন করে। পরবর্তীতে ঈশা খাঁর কাছে মান সিংহ পরাজিত হয়।

ইতিহাস

মূল নিবন্ধ: ময়মনসিংহের ইতিহাস

১ মে ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলা গঠিত হয় যার প্রথম কালেক্টর ছিলেন মিঃ এফ লি গ্রোস। এর আগে খাগডহর ইউনিয়নের বেগুনবাড়ীর কোম্পানির কুঠিসহ বিভিন্ন জায়গায় কাচারী বসত। কুঠি ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে বিলীন হলে শহরের উত্তর অংশে খাগডহরে কাচারী স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গনের কারণে সেই উদ্যোগও ভেস্তে যায়। পরবর্তীতে কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুরের দক্ষিণে কাওনা নদীর তীরে ‘দগদগা’ নামন প্রাচীন বাণিজ্যকেন্দ্রে জেলা শহর স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ঐ অঞ্চলের জমিদাররা এই সিন্ধানের বিরোধিতা করে। কর্তৃপক্ষ তাই ১৭৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেহড়া মৌজায় নাসিরাবাদ নাম দিয়ে জেলা শহরের পত্তন হয় । শহর স্থাপিত হওয়ার পর ৮ই এপ্রিল ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে পৌরসভা গঠিত হয় নাসিরবাদ মিউনিসিপ্যালিটি।বঙ্গদেশে এটি প্রথম এবং উপমহাদেশে এটি ছিল দ্বিতীয় পৌরসভা। মি. আরপর্চা ছিলেন পৌরসভার প্রথম অফিসিয়াল চেয়ারম্যান। প্রথম নন অফিশিয়াল চেয়ারউয়ান ছিলেন চন্দ্রকান্ত ঘোষ।[১] কালেক্টরেট ভবন ছিল ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রবিন্দু। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে সরকারী ডাক ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে জেলা বোর্ড গঠন করা হয়। প্রথম সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করা হয় ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে। ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রথম মুদ্রিত পুস্তক প্রকাশিত হয় ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে। ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম ইংরেজী স্কুল। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে। জেলার প্রথম আদম শুমারী পরিচালিত হয় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে। টেলিগ্রাফ অফিস স্থাপন ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে। । ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ চালু ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে, এবং ময়মনসিংহ-জগন্নাথগঞ্জ রেলপথ চালু হয় ১৮৬৫ সনে। ১৯০৫ সালে নাসিরবাদ নাম বদলে ময়মনসিংহ পৌরসভা নামকরণ হয়। ১৯১০ সালে পৌরসভার একতলা পাকা ভবন নির্মাণ হয় যেটি এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ময়মনসিংহ শহর

১৯৭১-এর ২৫ মার্চে ঢাকা শহরে গণহত্যা শুরুর অব্যবহিত পরে ময়মনসিংহের সংগ্রামী জনতা খাগডহর তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্প ঘেরাও করে এবং বাঙ্গালী ইপিআর সদস্যদের সহায়তায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে। এ যুদ্ধে ইপিআর সদস্য দেলোয়ার হোসেন ও ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের ড্রাইভার পুত্র আবু তাহের মুকুল শাহাদৎ বরণ করেন। মূলতঃ এই যুদ্ধের পর পরই ময়মনসিংহের সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত সীমান্ত ফাঁড়িগুলি বাঙ্গালী বিডিআরদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। নিহত পাক সেনাদের লাশ নিয়ে ময়মনসিংহবাসী বিজয় মিছিল করতে থাকে ও ধৃত অন্যান্য পাকসেনাদের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ময়মনসিংহ জেলখানায় প্রেরণ করা হয়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এক সকালে পুরাতন বিডিআর ভবনের ৩য় তলার শীর্ষে হাজার হাজার লোকের জয় বাংলা ধ্বনির মধ্যে বাংলাদেশের নকশা খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

ময়মনসিংহ শহরের একটি আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এইচ এস টি টি আই ২০১১

ময়মনসিংহ শহরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অসংখ্য। এগুলোর মধ্যে রয়েছে স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, কারিগরী বিদ্যালয় ইত্যাদি। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত।

ময়মনসিংহ শহর বাংলাদেশের অন্যতম শিক্ষানগরী হিসাবে পরিচিত । ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ,ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ, ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ, মোমেনশাহী, আলমগীর মনসুর (মিন্টু) মেমোরিয়াল কলেজ, ময়মনসিংহ জিলা স্কুল, বিদ্যাময়ী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরী হাই স্কুল,ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ইত্যাদি খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান

এখানে নোভিস ফাউন্ডেশন, উদীচী, অনসাম্বল থিয়েটার নজরুল একাডেমী, শিল্পকলা একডেমী সহ আরো বেশ কিছু সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

দর্শনীয় স্থানসমূহ

প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরের জানালা দিয়ে
১৯৭১ স্মৃতিসৌধের ফলক

শশী লজ
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা
স্বাধীনতা স্তম্ভ
ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্ক
ময়মনসিংহ জাদুঘর
বোটানিক্যাল গার্ডেন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বিপিন পার্ক

উপসনালয়

ময়মনসিংহ শহরের বড় মসজিদ

সমগ্র শহর জুরেই আছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা। বড় মসজিদ, ভাটি কাশর মসজিদ, ছোট কালীবাড়ি মন্দির, বড় কালীবাড়ি মন্দির, দশভুজা বাড়ি মন্দির, বিশ্বনাথ মন্দির, শিব বাড়ি মন্দির, দূর্গা বাড়ি মন্দির, অনন্তময়ী মন্দির, অনুকূল ঠাকুরের মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, লোকনাথের আশ্রম, মাসকান্দা পাদ্রি মিশন, গির্জা, গুরুদুয়ারা শিখ , ব্রাহ্ম মন্দির প্রভৃতি রয়েছে এখানে।

যাতায়াত ব্যবস্থা

ময়মনসিংহ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানের সাথে রয়েছে ট্রেন যোগাযোগ। রয়েছে আন্তঃনগর এবং মেইল ট্রেন উভয়ই।

আন্তঃনগর ট্রেনসমূহ হলো: যমুনা একপ্রেস, তিস্তা একপ্রেস, ব্রহ্মপুত্র একপ্রেস, অগ্নিবিণা, বিজয় (ময়মনসিংহ-কিশোর গঞ্জ,ভৈরব বাজার, কুমিল্লা-চট্টগ্রাম), হাওড় (নেত্রকোণ-ময়ম-ঢাকা) একপ্রেস।
মেইল ট্রেনসমূহ হলো: ধলেশ্বরী একপ্রেস, ভাওয়াল একপ্রেস, ময়মনসিংহ একপ্রেস, ঈশাখা একপ্রেস, মহুয়া একপ্রেস, জামালপুর কমিউটার, দেওয়ানগঞ্জ একপ্রেস।

এছাড়া সড়ক ও জলপথেও যাতায়াত করা যায় ময়মনসিংহে।

বাজার-ঘাট

নতুন বাজার,সানকি পাড়া বাজার, স্বদেশী বাজার, বড় বাজার, ছোট বাজার, মেছুয়া বাজার, কাচিঝুলি বাজার রয়েছে ময়মনসিংহে। এছাড়া সি.কে. ঘোষ রোড আর মিন্টু কলেজ মোড়েও রয়েছে বাজার। এগুলি সবই মূলত অনেক পুরাতন। যেমন স্বদেশী বাজারের নামকরণ হয়েছে স্বদেশী আন্দোলনের সময়।

জনজীবন, জীবিকা

ময়মনসিংহের মানুষের জীবন জীবিকা খুবই সাধারন। এ অঞ্চলের লোকজন বেশিরভাগই কৃষিকাজের সাথে যুক্ত। দারিদ্রতার হার ৩৯%। কৃষি ও শিল্পের দিক দিয়ে ময়মনসিংহ অনেক উন্নত।

বিখ্যাত ব্যক্তিগণ

  • উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
  • জগদীশ চন্দ্র বসু
  • সুকুমার রায়
  • রায় বাহাদুর সতীশচন্দ্র দত্ত
  • আনন্দমোহন বসু
  • সৈয়দ নজরুল ইসলাম
  • এ আর খান
  • যতীন সরকার
  • হেমেন্দ্রমোহন বসু
  • আবদুল জব্বার (১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদ।)
  • তসলিমা নাসরিন
  • জয়নুল আবেদিন
  • আবুল মনসুর আহমেদ
  • আবুল কাসেম ফজলুল হক
  • সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম
  • বেগম রওশন এরশাদ
  • গোলাম সামদানী কোরায়শী
  • মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ
  • আরিফিন শুভ
  • জ্যোতিকা জ্যোতি
  • সানিয়া সুলতানা লিজা
  • শুভাগত হোম চৌধুরী
  • মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত
  • ন্যান্সী

 

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top