গত ১৩ ফেব্রুয়ারি নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি, বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ, ভাষা আন্দোলনের অগ্রসেনানী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রথিতযশা কবি আল মাহমুদের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে ইবনে সিনা ট্রাস্ট। কবি গত ১১ জুলাই ৮৩তম জন্মদিন পালনের পর থেকে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে শুরু করেছিল। সহধর্মিণী চলে গিয়েছিলেন ক’বছর আগেই। এককালের তারুণ্যদীপ্ত কবি হয়ে পড়েছিলেন অত্যন্ত অসহায়। চোখের জ্যোতি কমেছিল আগেই, প্রখর স্মৃতিশক্তি তখন শুধুই অতীত।
খাওয়া-দাওয়া কমে গিয়েছিল- দুধ, সুপ, রুটি এমনকি তরল খাবার গিলতেও অসুবিধা। খাবার মুখে নিয়ে কবি বসে থাকতেন, গলায় আটকে যায় বলে গিলতে ভয় পেতেন। পারিবারিক চিকিৎসক ও নিউরো মেডিসিনের প্রফেসর অধ্যাপক ডা: মো: আবদুল হাইয়ের ভাষ্য মতে, ‘কবির কোনো রোগ নেই, জন্ম-মৃত্যুর চিরায়ত নিয়মেই অশীতিপর বৃদ্ধ কবির জীবনপ্রদীপ ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে- যেকোনো সময় আসতে পারে নিভে যাওয়ার সংবাদ।’ ১৬ ফেব্রুয়ারি পত্রিকার পাতায় চোখে পড়তেই দেখি- ‘সোনালী কাবিনের কবি আল মাহমুদ আর নেই।’
যারা আমার মতো লেখালেখির সাথে জড়িত, তাদের সবাই কোনো-না-কোনোভাবে কবি কিংবা তার সাহিত্য কর্মের সাথে সুপরিচিত। কবি আল মাহমুদের লেখার সাথে আমার পরিচয় শৈশবেই। যখন লেখাপড়া নিয়ে বাবা-মায়ের প্রচণ্ড তাড়না, তখন তিনি আমার মনের কথাটিই বলে গেছেন-
‘আম্মা বলেন, পড়রে সোনা/আব্বা বলেন, মন দে,/পাঠে আমার মন বসে না/ কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।/আমার কেবল ইচ্ছে জাগে/নদীর ধারে থাকতে/ বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে/পাখির মতো ডাকতে।/সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে/কর্ণফুলীর কূলটায়/দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি/ ফেরেশতারা উল্টায়।’
ছাত্রকালে কবির ‘পানকৌড়ির রক্ত’ পাঠ করে তাকে এক নজর হলেও দেখার ইচ্ছে জেগেছিল। স্কুলজীবন থেকে লেখালেখি শুরু হলেও ১৯৮৫ সালে প্রবেশ করি এর বিপরীত ভুবনে। ১৯৮৫ থেকে ২০০০ সাল। কঠিন দারিদ্র্যে হারিয়ে যেতে শুরু করেছিলাম সাহিত্য-সংস্কৃতির জগৎ থেকে। ২০০১ সালের দিকে প্রায় অর্ধশত বছর বয়সে আবার লেখালেখি শুরু। প্রবীণ বয়সে এসে নবীনদের মতো লেখালেখি অনেকটা ‘বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা’র মতো।
আমার বাড়ি মেঘনার কূলে। কবি আল মাহমুদ যে হাইস্কুলে লেখাপড়া করেছেন, সেই দাউদকান্দি সাধনা হাইস্কুল খুব দূরে নয়। কবি ১৯৫৪ সালে শহরে আসেন। তার আগ পর্যন্ত আমাদের মতো নদীবেষ্টিত এলাকায় বড় হয়েছেন কবি। তাই তার সাহিত্যের সাথে মিল রয়েছে আমাদের জীবনযাত্রার। ব্যক্তিজীবনে ‘মা’ই আমার সব। হারিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ‘মা’ হারিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারতাম না। আমার ‘মা’ হারিয়ে যাওয়ার পর, মাকে নিয়ে কবির লেখা,
‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে/ হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে/ নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?/ হাত দিও না, আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।’
কবির ‘নোলক’ কবিতার কয়েকটি চরণ হৃদয় থেকে মুছতেই পারিনি। পরিণত বয়সে খুব ইচ্ছে ছিল কবির পাশে বসে তাঁকে একটু ছুঁয়ে দেখার। এর উপলক্ষ খুঁজছিলাম। পেয়েও গেলাম। ‘টুইন টাওয়ারের দেশে’, ‘টুসি আমার টুসি’, ‘ভুল ভেজালে ভোলা’ ও ‘জ্বীন ভূতের অদ্ভুত সব কাণ্ড’- একসাথে এ চারটি বইয়ের প্রকাশনার অনুষ্ঠান জাতীয় প্রেস ক্লাব অডিটোরিয়ামে। সভাপতিত্ব করতে সম্মত হন কবি আল মাহমুদ। অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, কবি আল মুজাহিদী, কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরীসহ দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে সেদিন এক অপ্রীতিকর ঘটনায় কবি আল মাহমুদ বক্তব্য দিতে পারেননি।
কবির পরলোক গমনের সংবাদ শুনেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মনে পড়ল ৩০ আগস্ট ২০০৫ সালের সে অনুষ্ঠানের অপ্রীতিকর ঘটনাটি। ঘটনাটি হচ্ছেÑ প্রকাশকের পরামর্শে বড় করে প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে যাই। ৩০ আগস্ট ২০০৫ ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে একসাথে চারটি গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের আগে অনুমতির জন্য গিয়েছিলাম কবি আল মাহমুদের বাসায়। ১ নম্বর গুলশান প্রধান পোস্ট অফিসের কাছেই কবির বাসা। সত্তর বছর পেরিয়ে আসা কবিকে দেখতে বয়স্ক মনে হলেও শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে ছিলেন শক্ত। শায়িত ছিলেন। আমাকে দেখেই উঠে বসেন। প্রকাশনার বিষয়ে বিস্তারিত শোনার পর-
– আর কে কে থাকবেন?
পরিচিত কয়েকজনের নাম বলার পর,
– আমাদের কথা শোনার জন্য লোকজন পাবেন তো?
– লোকজন রাখব, যে করেই হোক।
কবি আল মাহমুদকে রাজি করিয়ে লোকজন রাখার দিকে মন দিলাম। আমার এক আত্মীয় প্রকাশনা অঙ্গনে কাজ করে, আরেক ভাতিজা স্থানীয় ছাত্রনেতা। তাদের পরামর্শ চাইতেই,
– কাকা, এসব অনুষ্ঠানে তো লোক হবে না।
– লোকজন হওয়ার জন্যই তো তোমাদের পরামর্শ!
– অনুষ্ঠানে হয়তো রাখতে হবে প্রথম শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা, নয়তো রাখতে হবে চটকদার শিল্পী।
– দূর বোকা, প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গানের শিল্পী রাখতে গেলে মানুষ হাসবে। তা ছাড়া মন্ত্রী-মিনিস্টাররা সাহিত্য অনুষ্ঠানে আসতে চাইবেন নাকি?
– আসবেন আসবেন, সব অনুষ্ঠানেই আসবেন।
তাকে নিয়ে প্রবীণ মন্ত্রী এম কে আনোয়ারকে দাওয়াত করতে গেলে তিনিও একই কথা বলেন,
– লোকজন হবে তো?
যা হোক, লোকজন উপস্থিত করার জন্য ব্যাপক প্রচার শুরু করলাম। সাথে শ’দুয়েক লোকের লাঞ্চ। পুরান ঢাকার হাজী বিরিয়ানি। আপেল-কমলা তো আছেই। খাবার বণ্টনের দায়িত্বে রাখা হয় ভাতিজা ও আরো কয়েকজনকে।
নির্ধারিত সময়ের আগেই অডিটোরিয়ামের আসন পূর্ণ হয়ে যায়। বারান্দাও ভরে উঠে দর্শক-শ্রোতায়। উপচে পড়া ভিড় দেখে কে বিশ্বাস করবে- বাঙালি বইপাগল নয়। এত লোকজন দেখে খুশি কবি আল মাহমুদ ও মন্ত্রী এম কে আনোয়ার। টান টান উত্তেজনা নিয়ে শুরু হলো সভা। মিনিট ১৫ পরই উঠে দাঁড়ান এম কে আনোয়ার। তার ড্রাইভারের বাবার মৃত্যু সংবাদ এসেছিল। নামাজে জানাজায় থাকতে চান মন্ত্রী নিজে। তাই তার বক্তব্য শেষ করে চলে যেতে চাচ্ছিলেন। সভাপতির অনুমতি নিয়ে বক্তব্য শুরু করেন এম কে আনোয়ার। বক্তব্য শেষ করেই সভাস্থল ছেড়ে গাড়ির দিকে রওনা দেন। তার পেছনে বের হয়ে পড়েন আরো কয়েক জন। মন্ত্রী ও তার সহগামী কয়েকজনের লাঞ্চ প্যাকেট দিয়ে দেয়ার জন্য ইশারা করি। অডিটোরিয়ামের উত্তর দিকে ছিল লাঞ্চের প্যাকেট ভর্তি চারটি কার্টন। কার্টন খুলতে দেখেই উত্তর দিকের লোকজন উঠে দাঁড়ায়।
লাঞ্চের প্যাকেট নিয়ে তারাও চলে যেতে চায় মন্ত্রীর সাথে। মুহূর্তেই সভা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। তখন চলছিল ইত্তেফাকের সাহিত্য সম্পাদক কবি আল মুজাহিদীর বক্তৃতা। মুজাহিদীর রসালো বক্তব্যের দিকে কান না দিয়ে সবাই মন দেয় লাঞ্চ প্যাকেটের দিকে। যারা বারান্দায় ছিল তারাও ঢুকে পড়ে অডিটোরিয়ামে। ঝুঁকে পড়ে কার্টনের ওপর। যে যতটা নাগালে পায় নিতে শুরু করে। দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই খালি হয়ে যায় কার্টন। প্রচণ্ড হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে দর্শকশূন্য হয়ে পড়ে অডিটোরিয়াম।
কবি আল মাহমুদ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানসহ কয়েকজন, প্রকাশক ও আমাদের আত্মীয়স্বজন ছাড়া সবাই চলে গেছেন। শেষ হয়ে গেছে লাঞ্চবক্সের চারটি কার্টনও।
সভাপতির ভাষণ দেয়ার জন্য কবি আল মাহমুদ যখন উঠে দাঁড়ালেন তখন অডিটোরিয়ামে সাজিয়ে রাখা চেয়ারগুলো শূন্য বিক্ষিপ্ত ও এলোপাতাড়ি রাখা। তবুও তিনি বক্তব্য রেখে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন। তার বক্তব্যের সারাংশ, ‘থামলে চলবে না, এর ভেতর দিয়েই লেখককে এগিয়ে যেতে হবে।’
‘তোমরা যারা শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয় পাখিই হবো
পাখির মতো বন্য।’
লেখাপড়া করে আমরা আর মানুষ হতে পারলাম কই! আল মাহমুদ ঠিকই পাখি হতে পেরেছেন। দুধ-কলা দিয়ে ৮৩ বছরেও এ পাখিকে পোষ মানাতে পারেননি। দেহপিঞ্জর ছেড়ে বাইরে আসার জন্য ছটফট শুরু করে দিয়েছিল পাখি। ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই থেকে দীর্ঘ ৮৩ বছরের পথশ্রান্ত কবি ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে চিরবিদায় নিলেন।
কবি আল মাহমুদ চেয়েছিলেন শুক্রবার পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে। অবশেষে তার ইচ্ছাই পূর্ণ হলো। রাত ১১টা ৫ মিনিটে যেন তার ইচ্ছানুসারেই শুক্রবারে মৃত্যুর ফেরেশতা এসে ডাক দিলে তিনি খুশি মনেই তার ডাকে সাড়া দিলেন। পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। কবির ভাষায়- ‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে/ মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;/ অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে/ ভালোমন্দ যা ঘটুক, মেনে নেবো এ আমার ঈদ।’
লেখক : আইনজীবী