গ্যাসের চাহিদা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। কিন্তু মজুদ বাড়ছে না। নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হওয়ায় গ্যাসের বিদ্যমান মজুদও ফুরিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে চাহিদা মেটাতে উচ্চমূল্যের জ্বালানি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে হচ্ছে। এতে বাড়ছে গ্যাসের গড় দাম। বেশি দামে আমদানি করে কম মূল্যে বিক্রি করায় ভর্তুকিও বেড়ে যাচ্ছে। এ ভর্তুকি কমাতে হলে গ্যাসের মূল্য বিদ্যমান দামের চেয়ে কয়েকগুণ বাড়াতে হবে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে সামনে পুরোপুরি উচ্চমূল্যের জ্বালানিনির্ভর হয়ে পড়বে দেশ। বিদ্যুতের উৎপাদনব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দাম বেড়ে যাবে সার ও অন্যান্য শিল্পজাত পণ্যের। বাড়বে সব ধরনের পণ্যের উৎপাদনব্যয়। ফলে দেশের শিল্পখাত অচলাবস্থায় পড়ে যাবে। এমনি পরিস্থিতিতে গ্যাস নিয়ে এই বহুমুখী সঙ্কট মেটাতে অভ্যন্তরীণ গ্যাসের অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, নতুন উৎপাদন না বাড়ানো পর্যন্ত ২০০৯ সাল থেকে আবাসিক ও শিল্পে গ্যাসসংযোগ বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে সীমিতভাবে কোনো কোনো সময় সংযোগ চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি অব্যাহত রাখা হয়নি। এর পরেও গ্যাসের চাহিদা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে গ্যাসের চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে ঘাটতি ছিল ৫০ কোটি ঘনফুট। এখন সরকারি হিসেবেই এ ঘাটতি ১০০ কোটি ঘনফুট ছাড়িয়ে গেছে। পেট্রোবাংলার গত ১৮ ফেব্রুয়ারির পরিসংখ্যান মতে ‘শিল্প, আবাসিক ও পরিবহন বাদে শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সার কারখানায়ই চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি রয়েছে ১২১ কোটি ঘনফুট।’ যেমন : ওইদিন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের চাহিদা ছিল প্রায় ২১০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ করা হয় ১১২ কোটি ঘনফুট। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি ছিল ৯৮ কোটি ঘনফুট। আর সার কারখানাগুলোতে ওইদিন গ্যাসের চাহিদা ছিল প্রায় ৩২ কোটি ঘনফুট। কিন্তু ওইদিন সরবরাহ করা হয় ১৮ কোটি ঘনফুট। ওইদিন সার কারখানাগুলোতে চাহিদার চেয়ে ১৪ কোটি ঘনফুট গ্যাস কম সরবরাহ করা হয়। শিল্প ও আবাসিকে গ্যাসসংযোগ উন্মুক্ত করে দিলে এ ঘাটতি আরো বেড়ে যেতো।
পেট্রোবাংলার সূত্র বলেছে, ২০১৪ সালের ১৪ জুন ঢাকার পার্শ্ববর্তী রূপগঞ্জে ছোট্ট একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। তারপর আর কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। আবিষ্কারের উদ্যোগও তেমন ছিল না। অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিকল্পনাপর্যায়েই আছে।
কিন্তু দেশে গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বাড়লেও গ্যাসের মজুদ তেমন বাড়েনি বরং মজুদ গ্যাস ব্যবহারের ফলে প্রতিনিয়তই তা কমে যাচ্ছে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হওয়ায় মজুদ দিন দিন কমে যাচ্ছে। কিন্তু গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর জন্য গত ১০ বছরে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। ঘাটতি পূরণে বিভিন্ন সময় কিছু কর্মসূচি নেয়া হলেও তা বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে পারেনি। এরপর বাপেক্সকে দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করানো হয়। তবে বাস্তবায়নপর্যায়ে যাওয়ার আগেই সেই পরিকল্পনার ভিত্তিতে দুই বছরের জন্য ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাাম’ ধরনের কার্যক্রম নেয়া হয়। ওই কর্মসূচিও তেমন বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে।
বর্তমানে গ্যাসের সঙ্কট মেটাতে গত ১৮ আগস্ট থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। প্রতিদিন ৪৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এপ্রিল থেকে ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করার কথা রয়েছে। কিন্তু বিপত্তি বেঁধেছে দাম নিয়ে। প্রতি হাজার ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে ব্যয় হচ্ছে ৩২ টাকা করে। এ পর্যন্ত চার হাজার কোটি টাকার এলএনজি আমদানি করা হয়েছে। প্রতি ঘনফুট বিক্রি করা হচ্ছে সাত টাকা ১৭ পয়সা করে। এতে এ পর্যন্ত সরকারের ভর্তুকি দিতে হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এপ্রিল থেকে এ ভর্তুকি আরো বেড়ে যাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকারের সামনে এখন দু’টি পথ খোলা রয়েছে। একটি হলো এলএনজির জন্য ভর্তুকি বাড়ানো, না হয় দাম বাড়ানো। বর্তমানে দেশীয় উৎপাদিত গ্যাসের প্রতি ইউনিটের গড় মূল্য পড়ছে প্রায় সাত টাকা। কিন্তু এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে ৩২ টাকা করে। এতে গড়ে প্রতি ইউনিটে গ্যাসের মূল্য পড়বে ১২ টাকা করে। সামনে এ হার আরো বেড়ে যাবে। তখন দাম বাড়ানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না। ভর্তুুকি না দেয়া হলে গ্যাসের মূল্য কয়েকগুণ বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম এ বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, উচ্চমূল্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বাংলাদেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দেখা দেবে। কারণ, বর্তমানে আমরা দেশীয় গ্যাস পাচ্ছি গড়ে সাত টাকা দরে। আর এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে প্রতি হাজার ঘনফুট ৩২ টাকা দরে। ফলে প্রতি ইউনিটের গড় উৎপাদন পড়ে যাচ্ছে ১২ টাকা হারে। কিন্তু সামনে গ্যাসের মূল্য আরো বেড়ে যাচ্ছে। এপ্রিল থেকে ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করা হবে। গ্যাসের বর্ধিত চাহিদা মেটাতে পর্যায়ক্রমে ২০০ কোটি ঘনফুট, ৩০০ কোটি ঘনফুট এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে হবে। তখন গ্যাসের মূল্য দ্বিগুণ, তিনগুন ও চারগুন পর্যন্ত বেড়ে যাবে। এতে আমরা আর সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস পাবো না, উচ্চমূল্যের গ্যাস ব্যবহার করতে হবে।
এলএনজি আমদানি না করার বিকল্প কী ছিল- এমন এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, একটাই বিকল্প সেটা হলো অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো। এ সুযোগও ছিল আমাদের। কিন্তু গত ১০-১৫ বছরে দেশে নতুন করে উল্লেখ করার মতো কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি। তিনি বলেন, ভারত ও মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হলেও সমুদ্রে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য অনুসন্ধান চালানো হয়নি। যদিও সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পর মিয়ানমার বেশ দ্রুততার সাথেই গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে।
তিনি বলেন, সমুদ্রবক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ গ্যাস আছে। যদি সেগুলো অনুসন্ধান ও উত্তোলন করা হতো, তাহলে এখন যে গ্যাস সঙ্কট রয়েছে তা হতো না। উচ্চমূল্যের জ্বালানি আমদানি করার প্রয়োজন হতো না। তিনি বলেন, দেশে গ্যাসের মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। বর্তমানে ১২ টিসিএফ গ্যাস মজুদ রয়েছে। প্রতি বছর এক টিসিএফ গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। সে হিসেবে ১২ বছরের মধ্যেই গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে যাবে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে দেশ সম্পূর্ণ উচ্চমূল্যের জ্বালানিনির্ভর হয়ে পড়বে। গ্যাসের দাম বেড়ে যাবে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে সব ধরনের পণ্যের উৎপাদনমূল্য। এতে শিল্পে অচলাবস্থা দেখা দেবে।
এ থেকে উত্তরণের উপায় কী- এমন এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, এ থেকে উত্তরণের একটাই পথ, আর তা হলোÑ অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে হবে। এ জন্য ব্যাপক ভিত্তিতে নতুন গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধান চালাতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাগরবক্ষে গ্যাস প্রাপ্তির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে এখন বাংলাদেশের ২৬টি ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি অগভীর ও ১৩টি গভীর সমুদ্রে রয়েছে। বিদেশী কোম্পানিগুলো যাতে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আগ্রহী হয়, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে এ জন্য একটি তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলতে হবে। মোট কথা গ্যাস উত্তোলন নিয়ে ব্যাপক ভিত্তিতে উদ্যোগ নিলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে গ্যাসের মজুদ ও উৎপাদন বেড়ে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।