দ্বিতীয়বার দায়িত্ব গ্রহণের পর শপথ গ্রহণ করলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।
শুক্রবার রাজধানীর একটি মিলনায়তনে দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দের সঞ্চালনায় পবিত্র কুরআন থেকে অর্থসহ তেলাওয়াতের মাধ্যমে শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়। এ সময় নবনির্বাচিত আমিরকে শপথ বাক্য পাঠ করান বাংলাদেশ জামায়াতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার মাওলানা এটিএম মা’ছুম।
এর আগে গত ৫ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ২০২৩-২০২৫ কার্যকালের জন্য আমিরে জামায়াত নির্বাচনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে পুনরায় দলটির আমির নির্বাচিত হন ডা. শফিকুর রহমান।
এদিকে শপথ গ্রহণকালে ডা. শফিকুর রহমান আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। কান্না বিজড়িত কণ্ঠে তিনি শপথ বাক্য পাঠ করেন। এ সময় এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
শপথের পর আমিরে জামায়াতের অনুরোধে দোয়া অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান এবং আমিরে জামায়াত ২০২৩-২০২৫ কার্যকালের জন্য কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার নবনির্বাচিত সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অতপর ডা. শফিকুর রহমান দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতিকে সামনে রেখে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।
তিনি তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমি আজ গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে তাদের স্মরণ করছি, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে স্থান লাভ করেছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ন্যায় বিচার, মানবাধিকার এবং ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যারা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, জুলুম-নির্যাতন বরণ করেছেন এবং এই আন্দোলন করতে গিয়ে যারা শাহাদাত বরণ করেছেন আমি তাদেরকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে স্মরণ করছি। আমি আরো স্মরণ করি স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীকে।’
ডা. শফিকুর রহমান আবেগ তাড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আামি আরো স্মরণ করছি ভাষা সৈনিক সাবেক আমিরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযম, সাবেক আমির ও মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক নায়েবে আমির মাওলানা একেএম ইউসুফ ও মাওলানা আবদুস সুবহান, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল ও মন্ত্রী জনাব আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান ও শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা এবং শহীদ মীর কাশেম আলীকে। সরকারের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে মজলুম অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী সাবেক নায়েবে আমির একেএম নাযির আহমাদকে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের সকলের শাহাদাত কবুল করুন, আমীন।’
আমিরে জামায়াত বলেন, ‘আমি অত্যন্ত দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্মরণ করি বিশ্ববরেণ্য মুফাসসিরে কুরআন মিথ্যা মামলায় আমৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক এমপি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে কারা প্রকোষ্ঠে আটক এটিএম আজহারুল ইসলাম ও সাতক্ষীরার গণমানুষের প্রিয় নেতা সাবেক এমপি আবদুল খালেক মণ্ডলকে। নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য জনাব শাহজাহান চৌধুরীসহ আলেম-উলামা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যারা কারাগারে আটক আছেন, তাদের সকলকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
আমিরে জামায়াত আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আন্দোলন। মানবতার মুক্তি ও কল্যাণের জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে দুনিয়ায় লক্ষাধিক নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। ইসলামের সুমহান আদর্শ ব্যতীত মহানবতার মুক্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত হতে পারে না। জামায়াতে ইসলামী দ্বীন প্রতিষ্ঠার সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যারা দ্বীন প্রতিষ্ঠা করেন মহান রাব্বুল আলামীন তাদের কাছ থেকে ঈমানের পরীক্ষা নেন। আমাদেরকে ঈমানের যে কোনো পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’
জামায়াতে ইসলামীর আমির দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ এক কঠিন পরিস্থিতিতে নিপতিত। দেশে আইনের শাসন, ন্যায় বিচার ও মানবাধিকার বলতে কিছু নেই, মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। দেশে আজ সংবিধান স্বীকৃত মতপ্রকাশের অধিকার এবং সভা-সমাবেশের কোনো সুযোগ নেই। মানুষের ভোটাধিকার বলতে কিছু নেই। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এই সরকারের আমলে দফায় দফায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে তা জনগণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, কৃষি উপকরণ এবং জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে বহুবার। দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। দুর্নীতি, ব্যাংক লুটপাট, শেয়ারবাজার, ডেস্টিটিনি ও হলমার্ক কেলেঙ্কারি, রিজার্ভ ফান্ডের টাকা চুরি, জুয়া, ক্যাসিনোসহ নানা অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি দেশকে আজ দেউলিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতে সীমাহীন অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে মানুষকে সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করেছে। এই সরকার দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দিয়ে দেশের যুব সমাজকে অনৈতিকতার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই শিক্ষাব্যবস্থার কুফল গোটা জাতি ভোগ করছে। মাদক ও অপসংস্কৃতির সয়লাবে আমাদের যুব সমাজ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। সরকার ইসলামে হারাম ঘোষিত মদের বৈধতা দিয়ে যুব সমাজের চরিত্র বিনষ্ট করার ব্যবস্থা করেছে। সরকারের হাত থেকে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, আলেম-উলামা, সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী কেউ নিরাপদ নয়। গোটা দেশ আজ এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিপতিত। এর হাত থেকে উদ্ধারের একমাত্র উপায় জনগণের নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা। সেই জন্যই প্রয়োজন দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবিলম্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। গোটা জাতি আজ দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য ঐক্যবদ্ধ। আমি দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অতীতে জনগণের ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিটি আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। অতীতে আমাদের প্রতিটি আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। ভবিষ্যতেও আমরা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ। জামায়াতে ইসলামী দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছে। আমি আমার প্রিয় দেশবাসীর কাছে দেশের বৃহৎ ইসলামী সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জন্য দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কাছে স্বৈরশাসকের পতন ঘটবে, মানুষের নায্য ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং মানুষ তার সকল অধিকার ফিরে পাবে ইনশাআল্লাহ। বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে ভূমিকা পালনের জন্য আমি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।’