পূজায় যাওয়ার সময় নৌকাডুবিতে ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার; এখনও নিখোঁজ ৪১

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় পুণ্যার্থীবোঝাই নৌকাডুবির ঘটনায় করতোয়া তীরে স্বজনদের আহাজারিতে শোকের মাতম চলছে। প্রতিনিয়ত মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এখন পর্যন্ত নৌকাডুবে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪৯ জনে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। এদিকে আরও ৪১ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে। এ দুর্ঘটনায় মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। নদীর প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকার ভাটি অঞ্চলজুড়ে মরদেহের তল্লাশি অভিযান চলছে।

নৌকাডুবি ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরও করতোয়া, এর ভাটিতে পুনর্ভবা, আত্রাই নদীর পাড় ধরেও স্বজনদের ছুটতে দেখা গেছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডুবুরি দল ভাটির দিকে মরদেহের সন্ধানে অভিযান চালাচ্ছে। সোমবার সকাল থেকে সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৪৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে রোববার উদ্ধার করা হয় ২৫টি লাশ। সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো ৪৩ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে নিখোঁজদের স্বজন ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দীপঙ্কর রায় সোমবার বিকাল ৫টার দিকে মোট ৪৭ জনের লাশ উদ্ধারের তথ্য দিয়েছিলেন। এছাড়া আরও ৪১ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান দীপঙ্কর জানিয়েছিলেন।

এদিকে নিখোঁজদের সন্ধানে সোমবার সকাল থেকে আবারো উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে রংপুর, কুড়িগ্রাম ও রাজশাহীর ডুবুরি দল।

পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, স্রোতের টানে হয়তো লাশগুলো আশপাশের নদ-নদীতে চলে গেছে। করতোয়া নদী থেকে প্রচুর বালু ও পাথর উত্তোলন করে থাকেন শ্রমিকরা। হতে পারে, লাশ সেই গর্তে পড়ে বালুতে ঢাকা পড়ে গেছে। এসব কারণে লাশ উদ্ধারে দেরি হচ্ছে বলে বোদা থানার ওসি সুজয় কুমার রায়।

উদ্ধার ডুবে যাওয়া নৌকাটির কতজন যাত্রী নিখোঁজ, সে তথ্য এখনো নিশ্চিত করে পাওয়া যায়নি। তবে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা প্রশাসনের কাছে ৬৬ জনের তালিকা দিয়েছেন। সেসব নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজ পাওয়া গেলে হয়তো কতজন মারা গেছেন সে বিষয়ে সঠিক পরিসংখ্যান জানা যাবে।

তবে এখনো অর্ধশত যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন বলে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নিশ্চিত করেন। এ ঘটনায় নিহতদের পরিবারের স্বজনদের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা করে, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার করে টাকা, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার করে টাকা ও আহতদের ৫ হাজার করে টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা করেছে।

এদিকে রোববার রাতে রেলপথ মন্ত্রী ও পঞ্চগড়-২ আসনের এমপি নুরুল ইসলাম সুজন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পরে সোমবার দুপুরে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান, ঠাকুরগাঁও-১ আসনের এমপি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি রমেশ চন্দ্র সেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। নিহতদের বাসায় গিয়ে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর নেন।

এর আগে রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুর আড়াইটার সময় মহালয়া পূজা উপলক্ষে মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাটে করতোয়া নদী হয়ে নৌকা দিয়ে বদেশ্বরী মন্দিরে যাওয়ার পথে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে।

এ ঘটনায় রাতে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দ্বীপংকর রায়কে প্রধান করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন। কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

সোমবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে করতোয়া নদীর তীরে স্বজনদের খুঁজতে আসেন মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের গেদীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মহাদেব রায় (৫০)। তিনি বলেন, তার দুই কাকি, মামাসহ আট স্বজন নিখোঁজ। তাদের কাউকে খুঁজে না পেয়ে করতোয়ার তীরে বিলাপ করছিলেন তিনি।

প্রিয়জনকে খুঁজে পাওয়ার আশায় জগেশ রায়, প্রদীপ চন্দ্রসহ কয়েকজন নৌকা নিয়ে নদীতে চষে বেড়াচ্ছেন। নিখোঁজদের ছবি নদীতীরের বাসিন্দাদের দেখাচ্ছেন আর বিলাপ করছেন। নিখোঁজদের সম্পর্কে কোনো ধারণাই দিতে পারছেন না দুর্ঘটনাস্থলের তীরের মানুষেরা।

এমন আরও অনেক স্বজনেরা বলেন, তারা নিখোঁজ স্বজনদের মরদেহ যেন বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন, সেই অপেক্ষায় আছেন।

নিখোঁজদের সন্ধানে সোমবার সকাল থেকে আবারো উদ্ধার কার্যক্রম চালায় রংপুর, কুড়িগ্রাম ও রাজশাহীর ডুবুরি দল। সকালে নদীতে চারটি লাশ ভেসে ওঠে। তাদের মধ্যে তিনজন পুরুষ ও একজন নারী। উদ্ধার হওয়া নারীর নাম কবিতা রানী (৫০)। তার বাড়ি মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের ফুটকীবাড়ি এলাকায়।

এরই মধ্যে পঞ্চগড় ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক শেখ মো. মাহবুবুল ইসলামের কাছে খবর আসে- ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার ভাটিতে দেবীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করেছেন। আরও ৩৫ কিলোমিটার ভাটিতে দিনাজপুরের খানসামা ফায়ার সার্ভিস দল করতোয়ার জিয়া ব্রিজের কাছে আরো একজনের ভাসমান মরদেহ উদ্ধার করেছে। তবে তখনো ওই উদ্ধারকৃত ৩ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এর কিছুক্ষণ পরে জালিয়াপাড়া ঘাটের কাছে কবিতা রানী নামে আরও এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করেন স্বজনরা। কবিতা রানী মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের ফুটকিবাড়ী গ্রামের হেমন্তের স্ত্রী বলে জানা গেছে।

Share this post

scroll to top