সোনালী কাবিনের কবি আল মাহমুদ তার সর্বশেষ টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমার জীবন হলো কবির জীবন। স্মৃতি-বিস্মৃতির জীবন। সব একটু একটু করে পাশ কাটিয়ে আমি বিস্মৃতি অতিক্রম করে চলে যাচ্ছি।
জীবনের চাওয়া-পাওয়া, তৃপ্তি-অতৃপ্তি বিষয়ে বরাবরের মতোই আল মাহমুদের স্পষ্ট উক্তি, আমি মানুষ। মানুষের অতৃপ্তি থাকে। কিন্তু তা আমি বাজারে বলে বেড়াই না। যা পাইনি তা নিয়ে কোনো খেদ নেই। কারণ তা আমার ভাগ্যে ছিল না। কিন্তু জীবনে যা পেয়েছি তার মূল্য এত বেশি এবং তাতে আমি এত অবাক হয়েছি যে, কি চাওয়া পাওয়ার ছিল তা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। মানুষ যেমন সুখে-দুখে কাতর হয়, ভালোবাসায় আনন্দ পায় তেমনি আমিও সুখে-দুখে কাতর হয়েছি, প্রেমে আকুল হয়েছি। ভালোবাসা পেয়েছি।
সাহিত্য কর্মে প্রথমে বামপন্থার প্রকাশ এবং পরে ইসলামী ভাবধারার চিন্তা স্পষ্ট হওয়ার মাধ্যমে কবির মতাদর্শিক পরিবর্তন সবার কাছে স্পষ্ট হয়। এ নিয়ে তুমুল ঝড় ওঠে সেই সময়কার বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে এবং তা চলে অনেক দিন। কবির চিন্তা ও মতাদর্শিক পরিবর্তন অনেককে অবাক করলেও তাদের অনেকে শেষ পর্যন্ত তাকে সম্মান জানিয়ে গেছেন সাহিত্যে তার ব্যতিক্রমী ও অমর সৃষ্টির কারণে।
আর জীবনের শেষ পর্যন্ত কবি প্রবলভাবে টিকে ছিলেন তার পরিবর্তিত চিন্তা ও আদর্শে এবং তিনি তার শেষ টিভি সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বলেছেন, তিনি একজন বিশ্বাসী মানুষ। তিনি বিশ্বাস করেন এ জীবনই শেষ নয়। মৃত্যুর পরে জীবন আছে। আর সেখানে তার চাওয়া স্বস্তিকর জীবন।
কবি আল মাহমুদের শেষ টিভি সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন দিগন্ত টিভির সাংবাদিক আমিরুল মোমেনীন মানিক। কবি তখন মোটামুটি সুস্থ। এরপর অনেক দিন চলে গেছে। অনেক গণমাধ্যমকর্মী তার কাছে গেছেন কিন্তু কোনো টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে তার আর কথা বলার সুযোগ হয়নি। এখানে কবির শেষ টিভি সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন : আপনাকে মানুষ কবিতার রাজপুত্র মনে করে। আপনার প্রতি মানুষের এই যে ভালোবাসা তাকে কিভাবে দেখেন।
আল মাহমুদ : বাহ! মানুষকে আমিও তো ভালোবাসি। মানুষকে যেহেতু আমি ভালোবাসি মানুষকে আমি বিনিময় দিতে জানি।
প্রশ্ন : সাহিত্যচর্চা করে আপনি এই জীবনে যা পেয়েছেন তাতে কি আপনি পরিতৃপ্ত?
আল মাহমুদ : আমি তো কম পাইনি। যথেষ্ট পেয়েছি। একজন মানুষ এক জীবনে এত পায় না। আমি এ জন্য কৃতজ্ঞ আমাদের দেশ ও জনগণের কাছে। আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন সবার কাছে। আমার পরিবেশের কাছে, প্রকৃতির কাছে। সবার কাছে।
প্রশ্ন : আপনি ভাষা আন্দোলনও করেছেন। ছোট ছিলেন তখন। কিশোর বয়সে ১০ লাইনের একটি কবিতা লেখার কারণে পুলিশ আপনার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছিল।
আল মাহমুদ : হ্যাঁ, পুলিশ হুলিয়া জারি করেছিল।
প্রশ্ন : সেই সময় এত সাহস কিভাবে এলো, এত ঝুঁকি কিভাবে নিয়েছিলেন।
আল মাহমুদ : যেহেতু কবিতাই আমি করতাম। কাব্যচর্চার ভেতরেই বড় হয়েছি। আর আমার সাথে যারা ছিলেন তারা সবাই সাহসী মানুষ ছিলেন। অনেক সাহসী মানুষ ছিলেন তারা। তাদের মনোবল থেকেই আমার মনে সাহস সৃষ্টি হয়েছে। আমি কোনো কিছু করলে দৃঢ়তার সাথে করেছি। কিছু বললে সে বলার একটা কার্যকরণ সম্পর্কসূত্র থেকেছে। এখনো তাই করি।
প্রশ্ন : এই চেতনা থেকেই কি আপনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন?
আল মাহমুদ : হ্যাঁ। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। আমি তখন কলকাতায় ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের জন্য যে প্রচারণার দরকার ছিল তাতে আমি অংশগ্রহণ করেছি।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের এই অভিজ্ঞতা নিয়েই তো আপনি ‘কাবিলের বোন’ লিখেছেন। অনেকের মতে মুক্তিযুদ্ধের ওপর এটা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, বাংলা ভাষায় যত উপন্যাস আছে তার মধ্যে।
আল মাহমুদ : শুধু মুক্তিযুদ্ধ কেন? বাংলা ভাষায় কয়টা উপন্যাস আছে। আঙুলে গোনো। খুব একটা বেশি তো নেই। তার মধ্যে কাবিলের বোন একটা উপন্যাস। একেবারে পরিপূর্ণ উপন্যাস। উপন্যাসের যে আঙ্গিক, রীতি, স্থাপত্য কৌশল এসব পুরোপুরি মেনে কাবিলের বোন লিখেছি আমি। এর প্রশংসাও আছে। সমালোচনাও আছে। সমালোচনা যে নেই তা না। কিন্তু আমি যে প্রশংসা পেয়েছি তা অল্প বাঙালি লেখক পেয়েছেন। আমার লেখার জন্য জীবিতকালে আমি সম্মান কম তো পাইনি। আমার কোনো নালিশ নেই কারো বিরুদ্ধে।
প্রশ্ন : কলকাতাতেও আপনার জনপ্রিয়তা রয়েছে।
আল মাহমুদ : কলকাতাতে আমি ছিলাম তো অনেক দিন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় আমি কলকতায় ছিলাম। আমার সাহিত্যের জন্য কলকাতা আমাকে আগে থেকেই চিনত।
প্রশ্ন : অনিমেষ আইচ নামক একজন পরিচালকের পরিচালনায় বাংলা ভিশনে আপনার একটি গল্প নিয়ে নাটক হয়েছে। আপনি কি জানেন?
আল মাহমুদ : হ্যাঁ। অনিমেষ আইচ আমার কাছে অনুমতি নিয়েছে।
প্রশ্ন : কলকাতায়ও আপনার লেখা নিয়ে ছবি হয়েছে।
আল মাহমুদ : হ্যাঁ। জলবেশ্যা নিয়ে। তারাও আমার অনুমতি নিয়েছে।
প্রশ্ন : এগুলো আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করছেন।
আল মাহমুদ : জলবেশ্যা আমি দেখিনি। আমি আশঙ্কা করেছিলাম বেশ অদল বদল হবে। কিন্তু আমি শুনেছি খুব একটা অদল বদল হয়নি।
প্রশ্ন : আপনি তো ছড়াও লিখেছেন এবং তাতেও সফল হয়েছেন। আবার ’৭১-এর পরে গল্পও লিখেছেন এবং সেখানেও সফল হয়েছেন।
আল মাহমুদ : এটা একজন লেখকের স্বাভাবিক কর্ম। ছোট গল্প আমি আগে থেকেই লিখতাম। কমবেশি লিখতাম। সেসব দুই খণ্ডে বেরিয়েছে।
প্রশ্ন : অনেকেই বলে থাকেন আপনার একটা বাঁক বদল হয়েছে। বিশ্বাসের বাঁক বদল। ’৭২-এর পরে।
আল মাহমুদ : এটি স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে। এমনিতে তো আর বদলায় না মানুষ। আমি পড়াশুনার মধ্য দিয়ে এসেছি। ব্যাপক পড়াশুনা করেছি। ব্যাপক পড়াশোনা, দেশ-বিদেশে ভ্রমণ নানা কারণে এটি হয়েছে। আমি ইউরোপ গিয়েছি। ফ্রান্সের প্যারিসের রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি। ফুটপাথ ধরে হেঁটেছি। পেজা তুলার মতো তুষারপাত হচ্ছে। একাকী হাঁটছি।
প্রশ্ন : ইসলামের সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কি আপনার এই বাঁক বদল হয়েছে।
আল মাহমুদ : ইসলামের সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, হ্যাঁ সেটিও বলতে পার। কারণ আমার তো ধর্মবিশ্বাস আছে। আমি একজন বিশ্বাসী মানুষ। আমি বিশ্বাস করি, আমার ধর্ম চেতনা যেটা তার ওপর দৃঢ়ভাবে আস্থা আছে আমার। যখন সময় আসে আমি বিপদে আপদে প্রার্থনা করি।
প্রশ্ন : মৃত্যুকে আপনি কিভাবে দেখেন?
আল মাহমুদ : মৃত্যুকে আমি আমার ধর্মীয় চেতনা থেকে দেখি। আমি বিশ্বাস করি মৃত্যুর পরে জীবন আছে। সেই জীবনে আমি থাকব।
প্রশ্ন : সেই জীবনে আপনার চাওয়া কি?
আল মাহমুদ : হ্যাঁ, স্বস্তিকর জীবন। শান্তির জীবনের আকাক্সক্ষা। মুত্যুর পর কী হবে তা তো আর জানা যায় না। তবে আমি এটুকু বলতে পারি, মুত্যৃতে আমার জীবন শেষ হবে না। মৃত্যুর পরও আমার জীবন আছে। সেখানে আমার সময় অতিক্রান্ত হবে। আমি ভালো যা করেছি তার জন্য সেখানে আমি পুরস্কৃৃত হবো। আর মন্দ যা করেছি, তার জন্য আল্লাহ যদি মাফ করে দেন তাহলে তো আর কোনো কথা নেই।
প্রশ্ন : আপনার সাহিত্য সম্পর্কে মূল্যায়ন করেন।
আল মাহমুদ : আমি গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া প্রবন্ধ লিখেছি। এর সংখ্যা অনেক। একেবারে কম না। খণ্ড খণ্ড হলে ১০ খণ্ড হবে। বেশ মোটা। এই যে লিখেছি। বিরামহীনভাবে লিখেছি। এখনো লিখছি। এই যে, তুমি বললে পোড়া মাটির জোড়া হাঁস। এ গল্প চিন্তা না করে লেখা যায় না। গভীর চিন্তা, মানুষকে ভালো করে দেখা। মানুষের জীবনকে ব্যাখ্যা করা, মানুষের আত্মাকে বর্ণনা করা। এটা তো আমি করেছি। আমি যতটুকু পেরেছি করেছি।
প্রশ্ন : অনেকে বলে থাকেন আপনি গান লিখেননি।
আল মাহমুদ : কথাটা তো ঠিক। কারণ আমার জন্ম হয়েছে যেখানে ব্রাহ্মহ্মহ্মণবাড়িয়া জেলা, এটি আসলে তো গানের এলাকা। বহু বড় বড় ওস্তাদের জন্ম হয়েছে সেখানে। আমার সমসাময়িক একজন বড় সঙ্গীতজ্ঞ নাম বাহাদুর হোসেন খাঁ। তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। কথাও হয়েছে। বেশি দিন আমরা একসাথে থাকতে পারিনি। কারণ পরে তিনি চলে গেলেন কুমিল্লায়। বাহাদুর হোসেন খাঁ, তার পরিবারের লোকজন আমার ক্লাসমেট ছিল। যেমন রাজা হোসেন খাঁ। এরা হলো সঙ্গীতের পরিবার। এদের ছেলেমেয়েরা আবার অন্যরকম। ঠিক আমাদের মতো না। তারা যন্ত্রে পারদর্শী। যদি আমি কবিতা না লিখতাম তাহলে আমি মিউজিশিয়ান হতাম। গানের লোক হতাম। শিল্পী হতাম কি না জানি না। কিন্তু গান আমার বিষয় হতো।
প্রশ্ন : আপনার কোনো অতৃপ্তিবোধ আছে? জীবনে কোনো কিছু পাননি বা যেমন কারো থাকে ওরকম হতে পারলে ভালো হতো।
আল মাহমুদ : আমি তো মানুষ। আর মানুষের অতৃপ্তি তো থাকে। অতৃপ্তি আছে আমার অনেক বিষয়ে। সেটি আমি বাজারে বলে বেড়াই না।
প্রশ্ন : দুয়েকটা বলবেন?
আল মাহমুদ : না। বলে বেড়াই না কারণ যা পাইনি সেটা পাইনি। সেটি আমার ভাগ্যে ছিল না। আর যেটি পেয়েছি সেটি এত বেশি, এত বিপুল যে, মনে হয় সেটি আমি না চাইতেই পেয়েছি। আশা করিনি। কিন্তু আমি পেয়ে গেছি। এই আরকি। জীবনটাই এ রকম।
প্রশ্ন : জীবনকে কি রকম দেখেন?
আল মাহমুদ : মানুষ যেমন সুখে-দুখে কাতর হয়, ভালোবাসায় আনন্দ পায় তেমনি আমিও সুখে-দুখে কাতর হয়েছি, প্রেমে আকুল হয়েছি। ভালোবাসা পেয়েছি। আমার জীবন হলো কবির জীবন। স্মৃতি বিস্মৃতির জীবন। সব একটু একটু করে পাশ কাটিয়ে আমি বিস্মৃতি অতিক্রম করে চলে যাচ্ছি। আসলে মানুষের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো মানুষ ভুলে যায়। যদি এই বৈশিষ্ট্য না থাকতো তাহলে মানুষের বড় বিপদ হতো। সূত্রঃ নয়া দিগন্ত