সময় এমন এক ড্রাগনের নখর যার আঁচড় থেকে রক্ষা নেই কারো। ওর আঁচড় দাগ কাটে প্রতিটি মানুষের শরীরে। প্রতিটি জীবনে বসে সময়ের দাঁত। কী নাদুস-নুদুস চেহারা। কী আনন্দঘন দীপ্তি!
কী উৎসবমুখর মুখ— এর সবকিছু বিক্ষত করে সময়ের নখ। সবকিছু জীর্ণতার দহনে দ্বগ্ধ হয়ে যায়।
আহা! সময় এত নিষ্ঠুর কেন? এত নির্মম কেন? কেন এত নির্মোহ মর্মান্তিক। জীবনের মুহূর্তগুলো কিভাবে বদলে দেয় সে। কিভাবে ধূসর করে জীবনের সব রঙ। কিভাবে উদরপূর্তি করে জীবনের সব স্মৃতির নুড়ি। অসহায় জলে ভাসিয়ে দেয় জীবনের ভেলা।
জীবনকে ঠেলে দেয় অতীত নামক হাঙ্গরের মুখে। অতীত এমন এক হাঙ্গর যার গহ্বর থেকে মুক্তি নেই কারো। সময় জীবনকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় সীমাহীন সমাপ্তির দিকে। এভাবে জীবন কেবল জীবনের কাছে অসহায় হয়ে কাতরায়। এ যেন জীবনের এক অন্যরকম ক্রন্দন। যার অশ্রুতে ভিজে ওঠে মানুষের অন্তর্দেশ।
জীবন যেন গুটিয়ে যায় জীবনের ভেতর। গোটাতে গোটাতেই ক্ষয়ে যায় সব। ক্ষীণ হয়ে ওঠে প্রত্যঙ্গগুলো। চোখের দৃষ্টি যেন চোখের ভেতর ঘোলা হয়ে থাকে কুয়াশার মতোন। কপালে বয়সের রেখাগুলো নদীর মতো বয়ে যায়। মুখের আদল বদলে মুছে যায় যৌবনের সব চিহ্ন। হায়রে জীবন! হায়রে মানুষের শরীর! হায়রে মানুষের ভাগ্যলিপি।
এসব অনুভূতি জাগ্রত হলো ভীষণভাবে। জাগ্রত হলো আল মাহমুদকে দেখতে গিয়ে। দেখতে গেছি ঈদের দু’দিন পর আমার পরিবার নিয়ে। সাথে ছিলেন কবি জামসেদ ওয়াজেদ।
আল মাহমুদ থাকেন তার বড় ছেলের বাসায়। বড় ছেলে শরীফ আল মাহমুদ। তিনিও সংবাদপত্র জগতের একজন। পাঁচ ছেলে তিন মেয়ে আল মাহমুদের। বড় ছেলের বাসাকেই তিনি বেছে নিয়েছেন বসতঘর হিসেবে। এই ছেলের বাসায় কাটে তার দিন রাত্রির মুহূর্তগুলো।
তাকে দেখে মনে হয় একজন বৃদ্ধ শিশু। শিশুরা যেমন জটিল কিছু বুঝে উঠতে পারে না। তিনিও পারেন না। শিশুর সারল্যে মুখটা জেগে থাকে সারাক্ষণ। চেয়ে থাকেন প্রায় নীরবে। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়েছে আগেই। এখন আরও। চেয়ে থাকেন তবুও। তবুও কৌতূহল প্রকাশ্য করার অনুভূতি জাগে তার। কথা বলেন ধীরে, অতি ধীরে। যেন বহুদূর থেকে বলছেন। যেনো বলছেন বেশ গভীর থেকে। দু’-চারটি কথা। থেকে থেকে। একটি কথা শেষ হলে দম নেন। চুপ থাকেন কিছুক্ষণ। মনে হয় দ্বিতীয়টি খুঁজছেন। আবার বলেন। আবার চুপ। মাঝে মাঝে ক্ষীণ দৃষ্টি তুলে চেয়ে থাকেন। যেন কিছু পাঠ করার চেষ্টা করছেন।
চোখের দৃষ্টি যেমন ক্ষীণ। চোখের অবয়বও ছোট হয়ে গেছে। সময়ের পর্দা যেনো ঝুলে আছে চোখের পাতার ওপর। মোটা কাচের চশমার ভেতর দিয়ে দুটি চোখ সামান্যটুকু খোলা। অথচ এ চোখ এ দৃষ্টি নিয়ে তিনি কত কিছুইনা লিখেছেন। লিখেছেন তার অতি দেখার দৈব বিমারের কথা। দেখার অতিরিক্ত দেখেন তিনি একথাই লিখেছেন নানাভাবে। বিভিন্ন কবিতায়। সেই দৃষ্টি আজ ঘোলা প্রায়। দেখার অধিক দেখা তো নয়ই। সামান্য দেখাই যেন এখন তার নিয়তি। তবুও তার অন্তর্দৃষ্টি এখনো খোলা। এখনো কবিতার কথা ভাবেন। এখনো লালন করেন কবিতার সুখ। কবিতা সৌরভ তার হৃদয়কে মথিত করে রেখেছে। স্মৃতি এখনো প্রখর। এখনো স্মৃতির আয়নায় খোঁজেন প্রিয় কোনো কবিতার স্তবক। প্রসঙ্গ এলে রবীন্দ্রনাথ নজরুল জীবনানন্দ থেকে কিংবা খনার বচন থেকে আবৃত্তি করেন তিনি।
তার পাশে বসে বসে ভাবছিলাম কত কি? ভাবছিলাম এই সেই কবি যার উপস্থিতিতে কোলাহল জেগে উঠত কত সাহিত্য আসরে। কত কবিতা সন্ধ্যায় প্রধান আকর্ষণ হতেন তিনি। কত সাংস্কৃতিক আয়োজনে থাকতেন সরব। এক ধরনের কাব্যিক অহঙ্কারে বিচরণশীল থাকতেন তিনি। থাকতেন আসরের মধ্যমণি হয়ে। এই মহানগরীর অলিগলি ঘুরে বেড়িয়েছেন। ঘুরেছেন সারা বাংলাদেশের আনাচ কানাচ। বাংলাদেশের সমস্ত নদীর পানি চেখে দেখেছেন— এ দাবী তাঁরই। উড়াল দিয়েছেন দেশ থেকে মহাদেশে। আধুনিক কবিতা নিয়ে বলেছেন নানা উক্তি। কত আলোচনা সমালোচনায় জমে ছিলেন তিনি।
আজ তার মুখের ভাষা প্রায় শূন্যের কোটায়। কলমের ভাষাও শেষের পথে। এখন নিজের ভেতর নিজেই শুধু থাকেন। জগতের আর কোনো অনুভূতি তাড়িত করে না তাকে। পৃথিবীর কোনো কাজের সাথে নেই তার সংযোগ। কোনো ঘটনার সাথে মেশেন না তিনি। মানুষের জীবনের রহস্য নিয়ে আজীবন শব্দ নির্মাণ করেছেন। নির্মাণ করেছেন কবিতার শরীর। আজ যেন তিনি নিজেই এক ধরনের গভীর রহস্য হয়ে বেঁচে আছেন। কখনো ঘুমে। কখনো জাগরণে। কখনো আধো ঘুম, আধো জাগরণ। কোনো কিছুর চাহিদা নেই। না খাওয়া-দাওয়া, না চাওয়া পাওয়ার। তিনি যেন এক নিরাসক্ত সময়ের প্রতিনিধি। পৃথিবীতে দিন রাতের পালাবদল ঘটছে। সময়ে সময়ে ঘটছে তারতম্য। রোদ বৃষ্টি মেঘ ছায়া। অথচ তার সময় একই রকম প্রায়। কখন সকাল। কখন দুপুর বিকেল। কখন সন্ধ্যা কিংবা রাত এ অনুভূতির ঊর্ধ্বে এখন তিনি।
এত কিছুর পরও এখনো লিখতে চান তিনি। এখনো চালিয়ে যেতে চান তার লেখার ট্রেন। তিনি বললেন— আমার একটি ইচ্ছে বলি তোমাকে।
বললাম— বলুন মাহমুদ ভাই। কি ইচ্ছে আপনার।
বললেন— আমি একটি কলাম লিখতে চাই।
বললাম— বাহ্ এ তো মহাআনন্দের কথা। অবশ্যই লিখবেন। আপনার লেখা পেলে আমরা কত যে আনন্দিত হবো। আপনার পাঠকেরা আপনার লেখার জন্য মুখিয়ে থাকে। অপেক্ষা তাদের কখন লিখবেন।
কিন্তু কথা আছে, ধীরে ধীরে বললেন— কথা হলো কাউকে লেখার জন্য পাঠাতে হবে। বলেই দম নিলেন।
বললাম— নিশ্চয় পাঠাবো। আপনি যখন বলবেন তখন পাঠাবো।
খুব খুশী হলেন। বললেন— একটা ভালো লেখা লিখতে চাই। তুমি ছাপবে কিন্তু। আশা করি খারাপ হবে না।
আনন্দ চিত্তে আবারো বললাম— আপনার লেখা পেলে আমরা ধন্য হবো। আমরা চাই আপনি লিখে যান। শেষ পর্যন্ত লিখে যান।
মহাকাব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম মহাকাব্যটি শেষ করবেন?
খুব উৎসাহের সাথে বললেন, শেষ করব। লিখব আমি। এটি একটি বড় কাজ। শেষ করতে চাই।
ঢাকা ইস্তাম্বুল আঙ্কারা নামে একটি ভ্রমণ কাহিনীর বই লিখেছেন বিশিষ্ট কলামিস্ট সাংবাদিক মাসুদ মজুমদার। বইটি উৎসর্গ করেছেন কবি আল মাহমুদকে। সঙ্গত কারণে বইটি আল মাহমুদের কাছে পৌঁছানোর পথ খুঁজছিলেন তিনি। যেহেতু নানাভাবে আল মাহমুদের সাথে সংযোগ আমার। বইটি তার কাছে পৌঁছাতে আমার হাতেই তুলে দিলেন তিনি।
বইটি আল মাহমুদের হাতে দিতেই বললেন— উৎসর্গ পাতায় কি লেখা পড়।
পড়লাম। খুশী হলেন তিনি।
উৎসর্গ পাতা ছাড়াও ভূমিকায় বইটি কেনো আল মাহমুদকে উৎসর্গ করা হলো তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা আছে। বললাম— মাহমুদ ভাইকে।
সে একই কথা, পড়।
পড়লাম। শুনে কিছুক্ষণ চুপ। মনে হলো, তিনি অতীত দিনের কোনো স্মৃতির ভেতর ডুবে গেলেন। কিছুক্ষণ। তারপর বললেন ভালো হয়েছে।
যখন খুশি হন ঝলমলিয়ে ওঠে চেহারা। আনন্দ প্রকাশের ধরনও অন্যরকম। একেবারে শিশুসুলভ। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের একটি বাণীর মর্মার্থ এমন— বার্ধক্যে ফিরে আসে মানুষের শৈশব। তা-ই মনে হয় আল মাহমুদকে দেখে। তাঁর শিশুসুলভ সুন্দর তাঁকে দিয়েছে অন্যমাত্রা। বাড়িয়েছে কাব্যিক সৌন্দর্য। এবং তাঁর চেহারায় চিত্রিত পূর্ণতার দ্যুতি।