দাহ্য পদার্থের তথ্য গোপনে এত মৃত্যু, ডিপো’র মালিক পলাতক

বিএম কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ সেখানে দাহ্য পদার্থ থাকার তথ্য না দেয়ায় আগুন ও বিস্ফোরণে এত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে৷ ঘটনার পর থেকে প্রতিষ্ঠানের মালিক আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমান রহমান গা ঢাকা দিয়েছেন৷

শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে লাগা আগুন ২৪ ঘণ্টা পরও নিয়ন্ত্রণে আসেনি৷ ফায়ার সর্ভিসের ২৫টি ইউনিট ছাড়াও আগুন নিয়ন্ত্রণে সেনা ২৫০ জন সেনা সদস্য কাজ করছেন৷ ঢাকা থেকে পাঠানো হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কেমিকেল আগুন নেভানোর বিশেষায়িত দল ‘হাজমত’ টিম৷

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডে নিহতের সংখ্যা ৪৯ জন৷ তাদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ৯ জন৷ আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪০০ জন৷ তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ আহত কয়েকজনকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে ঢাকা আনা হয়েছে৷ আরো আহতদের আনা হবে৷ হাসপাতালগুলোর পরিবেশ আহত এবং নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে৷

আগুনের সূত্রপাত:

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ ও আগুন লাগে শনিবার রাতে। বিস্ফোরণের পর ডিপোতে আগুন ধরে যায়। আগুন এখনো জ্বলছে। কিছুক্ষণ পরপর বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই ঘটনায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের দুই কর্মীসহ অন্তত ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক ( মিডিয়া) শাহজাহান শিকদার জানান, ‘আগুন লাগার পর কনটেইনার ডিপোর মালিকপক্ষকে আমরা পাইনি৷ তাদের কেউ আমাদের জানায়নি যে সেখানে কেমিকেল আছে৷ তথ্য জানা না থাকায় আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মারা যান৷ কারণ কেমিকেল থেকে লাগা আগুন নেভানোর কৌশল আলাদা৷ ভিন্ন ধরনের পার্সোনাল প্রটেকটিভ সরঞ্জাম লাগে৷ কেমিকেলের তথ্য না জানায় ফায়ার ফাইটার যারা ফ্রন্ট লাইনে ছিলেন তারা মারা যান৷’

তিনি বলেন, ‘কনটেইনার ডিপো করতে হলে ফায়ার লাইসেন্স দরকার হয়৷ এটা ছাড়া ডিপো করা যায় না৷ আর কোনো দাহ্য পদার্থ বা কেমিকেল থাকলেও তা জানিয়ে রাখতে হবে ফায়ার সার্ভিসকে৷ আমরা সেখানে অনেক কেমিকেলের উপস্থিতি পাচ্ছি৷ বিভিন্ন ধরনের কেমিকেলের অনেক ড্রাম রয়েছে সেখানে৷ তাদের ফায়ার লাইসেন্স আছে কী না আমরা তদন্ত করে দেখছি৷ তবে আমাদের তারা কেমিকেলের তথ্য জানায়নি এটা নিশ্চিত৷’ তিনি বলেন, ‘এখন আমরা ড্রোন ব্যবহার করে কেমিকেল চিহ্নিত করছি৷ ফোম ব্যবহার করে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি৷’

চট্টগ্রামের কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম জানিয়েছেন ওই ডিপোতে রফতানির জন্য হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিল৷ এখান থেকে অনেক দিন ধরেই এটা রফতানি হচ্ছে৷ এটা তারা ডিক্লারেশন দিয়েই রফতানি করে৷ তবে এর বাইরে আর কোনো কেমিকেল এখানো রাখা ছিলো কী না তা তাদের জানানো হয়নি৷ তার কথা, ‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড কোনো দাহ্য পদার্থ বা বিস্ফোরক নয়৷ তবে যেকোনো জিনিসেই আগুন লাগতে পারে৷ কেউ আগুন লাগিয়ে দিতে পারে৷ আমি শুনেছি হাইড্রোজেন পার অক্সাইড-এর পাফে স্টাপল ফাইবারের একটি কনটেইনার ছিলো৷ সে কারণেও আগুন ছড়াতে পারে৷ অটোমেটিক কোনো বিস্ফোরণ ঘটেনি৷ সেটা হলে জাহাজেও তো বিস্ফোরণ ঘটত৷’

এদিকে বিস্ফোরক অধিদফতরের উপ-প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক ড. মো. আবদুল হান্নান জানান, ‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড কোনো বিস্ফোরক বা দাহ্য পদার্থ নয়৷ যে ৫৪টি দাহ্য পদার্থের তালিকা আছে তার মধ্যে এটা নেই৷ ফলে এটা আমদানি বা রফতানিতে আমাদের অনুমোদন লাগে না৷’

তবে তার কথা, ‘অন্য কোনো বিস্ফোরক বা কেমিকেল সেখানে থাকতে পারে৷ আগুন ও বিস্ফোরণের ভয়াবহতায় তাই মনে হচ্ছে৷ সেটা তদন্ত করে দেখা দরকার৷’

স্থানীয় সংসদ সদস্য দিদারুল আলম জানান, বিস্ফোরণ ও আগুনের ঘটনার সংবাদ পেয়ে রাতেই সেখানে যান তিনি৷ গিয়ে দেখেন মালিক পক্ষের কেউ নাই৷ সবাই পালিয়েছে৷

তিনি বলেন, ‘সেখানে আমি অনেক কনটেইনারে তরল কেমিকেল দেখেছি৷ বিস্ফোরণে কয়েক মাইল এলাকা কেঁপে উঠেছে৷ অনেক দূরে গিয়েও আঘাত করেছে বিস্ফোরিত কনটেইনারের বিভিন্ন অংশ৷’ তিনি জানান, ওখানে কেমিকেল, গার্মেন্টস পণ্য সব একসাথে ছিল৷ দাহ্য পদার্থের আলাদা কোনো ব্যবস্থাপনা ছিলো না৷ অগ্নি নিরাপত্তা বলে কিছু ছিলো না বলে জানান তিনি৷

এদিকে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘ওই কনটেইনার ডিপোর কোনো কমপ্লায়েন্স নেই, এটা দুঃখজনক৷ আমরা ব্যবসায়ীরা যারা রপ্তানি করি তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি৷ বিজিএমইএ বলছে, ১০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক পুড়ে গেছে৷’

মালিকরা পালিয়ে গেলেও ডিপোর মূল প্রতিষ্ঠান স্মার্ট গ্রুপের আরেকটি প্রতিষ্ঠান চিটাগং ডেনিম-এর জিএম মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী ঘটনাস্থলে রয়েছেন৷ তিনি দাবি করেন, ‘ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিল এটা নিশ্চিত৷ অন্য কোনো কেমিকেল ছিল কী না তা বলতে পারছি না৷’

তিনি জানান, ‘ডিপোতে প্রায় সাড়ে চার হাজার কনটেইনার ছিল৷ এর মধ্যে ৯০ ভাগই গার্মেন্টস পণ্য৷ কাজ করছিল ৫৫০ জনের মত কর্মী৷’

মলিক পক্ষের লোকজন কেন পালিয়ে গেল এবং তাদের কেন পাওয়া যাচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা ভয় পেয়েছেন, তাই প্রকাশ্যে আসছেন না৷’

বিএম কন্টেইনার ডিপোর মালিক ও মূল প্রতিষ্ঠান স্মার্ট গ্রুপের এমডি মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ৷ তিনি গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন বলে স্থানীয় লোকজন জানান৷ তিনি একইসাথে চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিক পূর্বদেশের সম্পাদক৷ তিনি এবং মালিক পক্ষের অন্যরা এখন পলাতক৷ পত্রিকা, কনটেইনার ডিপো ও তৈরি পোশাক কারখানাসহ ১২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে তাদের৷

Share this post

scroll to top