উনিশ উননব্বই সালের ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে পৃথিবীটা ছিল অনেক অন্যরকম।
কিন্তু ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি সেদিনই ফতোয়া জারি করেছিলেন ‘দি স্যাটানিক ভার্সেস’ রচয়িতা ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক সালমান রুশদীকে হত্যা করার জন্য – ব্রিটেনের মুসলিমদের ওপর তার এক বিরাট ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল।
যেমন এলিয়াস কিরমানির কথাই ধরুন।
তার বড় হয়ে ওঠা লন্ডনের টুটিং এলাকায়, এক পাকিস্তানি পরিবারে। বাবা বাস ড্রাইভার। তার পরিবারে ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু এলিয়াসের এ নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না।
“আমরা বাবা-মায়ের কথা শুনতাম, মসজিদে যেতে হবে বললে যেতাম। কিন্তু আমাদের একটা গোপন দ্বিতীয় জীবন ছিল। আমরা পার্টি করতাম. গাঁজা খেতাম, মেয়েদের সাথে বেড়াতে যেতাম এবং সম্ভব সবকিছুই করতাম।”
পাকিস্তানি মুসলিম পরিচয় থেকে সরে যেতে তিনি গেলেন বাড়ি থেকে অনেক দূরে – গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে।
“তখন আমি বাদামি চামড়ার বন্ধু চাইতাম না। আমার সব বন্ধুই ছিল শ্বেতাঙ্গ, উদার, সমাজের মূল ধারার – সেটাই ছিল আমার জগৎ।” তার ছাত্রজীবন ছিল খুবই আনন্দের, তার সঙ্গী ছিল মিউজিক, নাচ, ক্লাব ইত্যাদি।
কিন্তু ১৯৮৯ সালে এমন একটা ঘটনা ঘটল যা সবকিছু বদলে দিলো। সালমান রুশদীর উপন্যাস স্যাটানিক ভার্সেস – যাকে মুসলিম বিশ্বে অনেকেই ধর্মদ্রোহী বলে মনে করেন – তার জন্য আয়াতোল্লাহ খোমেনি রুশদীকে হত্যা করার ফতোয়া এবং পুরস্কার ঘোষণা করলেন।
রুশদীকে হত্যা করা উচিত এমন চিন্তা এলিয়াস সমর্থন করতেন না, কিন্তু স্যাটানিক ভার্সেস বইটা যে ঠিক আছে তা-ও তিনি মনে করতেন না। কিন্তু খোমেনির ফতোয়ার সাথে তার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও – এলিয়াস দেখলেন তাকেই এ জন্য দোষারোপ করা হচ্ছে।
“আমার মনে হলো, আমার বন্ধুরা আমাকে বুঝতে পারে, এবং তারা আমাকে মেনেও নিচ্ছে কিন্তু এখন তাদের প্রশ্নগুলো হয়ে যাচ্ছে এই রকম : ‘তোমাদের সমস্যাটা কি?”তোমরা এরকম করছ কেন?”সালমান রুশদীকে তোমরা হত্যার হুমকি দিচ্ছ কেন?’ ”তুমি কার পক্ষে? আমাদের পক্ষে না ওদের পক্ষে?’
এলিয়াস মসজিদে যেতে অস্বস্তি বোধ করতেন। সেসময় মসজিদ চালাতেন দক্ষিণ এশিয়ান বয়স্ক পুরুষরা – যাদের প্রথম ভাষা ইংরেজি ছিল না। ফলে এলিয়াস অপেক্ষাকৃত তরুণ ইংরেজিভাষী মুসলিমদের কাছে দিকনির্দেশনা চাইলেন।
তারা তাকে তার বাবা-মায়ের ধর্মের সাথে যুক্ত করিয়ে দিলেন ঠিকই – কিন্তু তাকে নিয়ে গেলেন একটা র্যাডিক্যাল দিকে। সেখানে মূলত আলোকপাত করা হতো বৈশ্বিক মুসলিম পরিচয়ের দিকে – ঠিক নৈতিকতা বা আধ্যত্মিকতার দিকে নয়।
“এটা ছিল একটা কাউন্টার-কালচার, যাকে বলা যায় পাল্টা সংস্কৃতি। এর নিজস্ব পোশাক আছে, আছে নিজস্ব ভাষাও। আমি আমার অমুসলিম বন্ধুদের ত্যাগ করলাম এবং পুরোপুরি এই আন্দোলনে মনোনিবেশ করলাম” – বললেন এলিয়াস।
“স্যাটানিক ভার্সেস প্রকাশ, এবং আমাকে দূরে ঠেলে দেয়া দিয়েই এর শুরু । সে কারণেই আমি সব সময় বলি – আমি রুশদীর সন্তানদের একজন। শ্বেতাঙ্গ উদারপন্থীদের দ্বারাই আমি উগ্রপন্থায় দীক্ষিত হয়েছি।”
এলিয়াস যে সালাফি মতাদর্শের অনুসারী হলেন – তারা দক্ষিণ এশীয় ইসলামের চেয়ে অনেক বেশি পিউরিট্যানিকাল বা গোঁড়াপন্থী – এবং তার রাজনৈতিক ঝোঁকটাও খুবই স্পষ্ট। এলিয়াসের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বসনিয়ায় যুদ্ধ করতেও গিয়েছেন, তবে তিনি নিজে ছিলেন প্রচারক, যুদ্ধ করতে কখনো যাননি।
তবে এখন এলিয়াসের চিন্তাভাবনা নমনীয় হয়েছে।
“আগে আমাদের চিন্তা ছিল সাদা-কালো। ভালো আর মন্দ, পক্ষে বা বিপক্ষে, হালাল বা হারাম। কিন্তু এখন আমি সাদা আর কালোর মাঝখানের ধূসরটাই পছন্দ করি।”
এখন তিনি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম – যিনি মধ্যপন্থার কথা বলেন, হাডার্সফিল্ড আর ব্রাডফোর্ড শহরে মুসলিমদের মধ্যে যৌনতা, সম্পর্ক বা মানসিক স্বাস্থ্যর মতো বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
ইয়াসমিন আলিভাই-ব্রাউনের কথা
১৯৮০র দশকে ইয়াসমিন আলিভাই-ব্রাউন ছিলেন নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক।
তার কাছে সালমান রুশদী ছিলেন একজন ‘হিরো’ – শুধু তার লেখার জন্য নয়। এ কারণেও যে রুশদী ব্রিটেনের বর্ণবাদ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতেন।
সুতরাং ইয়াসমিন স্যাটানিক ভার্সেস বইটি পড়লেন।
“আমি অবমাননা বোধ করিনি, আমি সে ধরণের মুসলিম নই। কিন্তু আমি ভাবলাম সে কেন এটা করলো। আমার মনে হলো যে এটাতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উস্কানি দেয়া হচ্ছে” – বললেন তিনি।
যখন বইটি পোড়ানো শুরু হলো, তখন ইয়াসমিনের শ্বেতাঙ্গ বন্ধুরা অনেকেই ক্ষুব্ধ হলেন।
“খুব দ্রুতই এটা ‘ওরা এবং আমরা’ এমন একটা ব্যাপারে পরিণত হলো। কোন ডিনার পার্টিতে আমি রুশদীর ব্যাপারে ভিন্নতম প্রকাশ করলে লোকজন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতো। এত কঠিন একটা অবস্থা সৃষ্টি হলো।”
ইয়াসমিন বলছিলেন, তার জন্য এটা একটা ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার মত ব্যাপার হলো।
“আমি একজন মুসলিম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলাম। আমি বললাম, আমি মুসলিম, আমার মা মুসলিম, পরিবার মুসলিম। শ্বেতাঙ্গ উদারপন্থীরা – যাদের সাথে আমি কাজ করতাম তারা অবাক হলো। তারা কখনো আমাকে এভাবে দেখেনি। তাদের জন্য এটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠলো।”
এলিয়াসের চাইতে কয়েক বছরের ছোট এড হুসেইন, তখন তিনি স্কুলে পড়েন।
স্যাটানিক ভার্সেস-এর বিরুদ্ধে লন্ডনের হাইড পার্কে যে বিক্ষোভ হয়েছিল – তাতে তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার বাবা। ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর থেকে ২০ হাজার লোক এতে যোগ দিয়েছিল।
এতে রুশদীর কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়, প্ল্যাকার্ডগুলোতে যে বার্তা লেখা ছিল তাতে সহিংসতার হুমকি ছিল সাধারণ ব্যাপার। তবে লোকে যখন স্যাটানিক ভার্সেসে বইটার কপি পোড়াতে শুরু করলো – তখন এড-এর বাবা বললেন, এখন এখান থেকে চলে যেতে হবে।
বাড়ি ফিরে তিনি বললেন, তারা ‘এ ধরণের মুসলিম’ নন।
কিন্তু এড হুসেইন এর পর থেকে ধর্মের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তিনি ইস্ট লন্ডন মসজিদে যেতে শুরু করলেন।
সেখানে ইংরেজি-ভাষী ইমামরা রাজনৈতিক কথা বলতে পিছপা হতেন না, আর এ কারণেই ইস্ট লন্ডন মসজিদের নাম হয়েছিল।
রাজনৈতিক ইসলামের প্রতি এডের ঝোঁক শেষে এমন জায়গায় গেল যে তার বাবা বললেন, এ বাড়িতে থাকতে হলে তাকে ইসলামিস্ট রাজনীতি ছাড়তে হবে, নয়তো আলাদা থাকতে হবে।
এড তখন বিশ্বের মুসলিমদের জন্য কাজ করার ঐশী ব্রত নিয়ে এতই পাগল যে তিনি বাড়ি ছাড়ার বিকল্পটিই বেছে নিলেন।
তবে বেশি দিন বাইরে থাকতে হলো না। তার বাবা তাকে আবার ঘরে ফিরিয়ে আনলেন। তবে এড উগ্রপন্থা ছাড়লেন না।
এড বললেন, “আমি হিজবুত তাহরির-এর মতো আরো উগ্রপন্থী সংগঠনে গেলাম – যারা বৈশ্বিক খিলাফত প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাস করে।”
তিনি বলছেন, তার ধর্মীয় সত্তার কেন্দ্রে ছিল আধ্যত্মিকতা নয়, বরং বিশ্বজুড়ে অবিচার আর নিপীড়নের ধারণা।
“যেসব পার্কে আমরা সালমান রুশদীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলাম – তা এখন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতির প্রতিবাদে ব্যবহৃত হতে লাগল। একজন লেখকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকে আমরা সরে গেলাম ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতার দিকে। আমরা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক হয়ে গেলাম।
কলেজে পড়ার সময় খ্রিস্টান বলে মনে করা হয় এমন একটি ছেলের ওপর একটি আক্রমণের ঘটনা নিজের চোখে দেখলেন এড হুসেইন।
তিনি বলেন, এটা ছিল ‘মুসলিম শ্রেষ্ঠত্ববাদী মানসিকতা’-প্রসূত।
এড হুসেইন বলছিলেন, “যে লোকটি তাকে হত্যা করেছিল সে ক্যাম্পাসে এসে বলেছিল, তোমাদের কারো যদি কুফফার(অমুসলিম)দের সাথে কোনো সমস্যা হয় তাহলে আমাকে বলবে। কয়েক সপ্তাহ পর আমি দেখলাম এই বাচ্চা ছেলেটিকে ছুরি মারা হয়েছে, সে রাস্তায় পড়ে আছে, ধড়ফড় করছে।”
এড বললেন, তার জন্য এ ঘটনা ছিল একটা ‘জাগরণী-বার্তা।’
তিনি বুঝলেন, তিনি তার ধর্মের যা কিছু ভালোবাসেন তা দেখার দৃষ্টি তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি হিজবুত তাহরির থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলেন।
এর পর তিনি টোনি ব্লেয়ারের একজন উপদেষ্টা হন, এবং উগ্রপন্থা-বিরোধী সংস্থা ‘কুইলিয়াম ফাউন্ডেশনের’ অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও ছিলেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি