সরকারি ওয়েবসাইটের মানচিত্রে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপকে আবারো নিজেদের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে মিয়ানমার। এ ঘটনার প্রতিবাদে মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত (সিডিএ) অং খোয়াকে তলব করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সিডিএ তাৎক্ষনিকভাবে ভুল স্বীকার করে ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি না হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
গত অক্টোবরেও মানচিত্রে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপকে নিজ দেশের অংশ হিসাবে দাবি করেছিল মিয়ানমার। উষ্কানিমূলক এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত লুইন উ’কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়েছিল। ঘটনাটিকে ‘অনিচ্ছাকৃত’ মন্তব্য করে দু:খ প্রকাশ করেছিলেন রাষ্ট্রদূত। এরপর মিয়ানমার মানচিত্র সংশোধন করে নেয়। কিন্তু আবারো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায়।
সেন্টমার্টিন নিয়ে মিয়ানমারের কর্মকান্ডকে ‘দূরভিসন্ধিমূলক’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অণুবিভাগের মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসেন মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে তলব করে একটি প্রতিবাদপত্র দেন। প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, মিয়ানমারের একটি সরকারি ওয়েবসাইটে মানচিত্রের যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার কিছু অংশ রয়েছে। বাংলাদেশ এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। অবিলম্বে এই মানচিত্র সংশোধনের জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানায় বাংলাদেশ।
দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, গত বছরের ৬ অক্টোবর মিয়ানমার তাদের একটি সরকারি ওয়েবসাইটে একই ধরনের কাজ করেছিল। তখন আমরা এর প্রতিবাদ করে মানচিত্রের সংশোধনী আনার কথা বলি। বাংলাদেশের চাপের মুখে তারা সেটি সংশোধন করে। এরপর চলতি মাসে দেশটির আরেকটি ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার কিছু অংশকে নিজেদের মানচিত্রে দেখিয়েছে মিয়ানমার। আমরা মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত অং খোয়াকে তলব করে তার কাছে জানতে চেয়েছি তারা বারবার একই ভুল কেন করছে? অং খোয়া ভুল স্বীকার করে বলেছেন, এটি ঘটার কোনো কারণ ছিল না।
মহাপরিচালক বলেন, আমরা অবিলম্বে এই ভুল সংশোধন করতে বলেছি। এরপর মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত আমার অফিস থেকেই তাদের দেশে যোগাযোগ করেছেন। আগামীকাল শুক্রবার তাদের কর্মদিবস রয়েছে। শুক্রবারের মধ্যেই তারা মানচিত্রের ভুল সংশোধন করে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, অক্টোবরের ঘটনার পর মিয়ানমার বলেছিল ওয়ান ম্যাপ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে এই ম্যাপ তৈরী করা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রতিবাদের মুখে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ভুল স্বীকার করে বিনাশর্তে মানচিত্রটি সরিয়ে নিয়েছিল। আমরা জেনেছি সম্প্রতি মিয়নামারের সরকারি ওয়েবসাইটে এ ধরনের মানচিত্র আবারো ব্যবহার করা হয়েছে। তাই মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডাকা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে থেকে দৃষ্টি সরাতে মিয়ানমার ইচ্ছাকৃতভাবে এই কাজটি করেছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর নজীরবিহীন দমন-পীড়ন চালায়। এ সময় সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। বিষয়টি থেকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি সরাতে বাংলাদেশকে সঙ্ঘাতে জড়াতে উষ্কানি দিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হেলিকাপ্টার ও ড্রেন বারবার সীমান্ত লঙ্ঘন করেছে। মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে একাধিকাবার তলব করে বাংলাদেশ এর প্রতিবাদ জানিয়েছিল। তবে কোনো ধরনের সামরিক সঙ্ঘতে জড়ায়নি বাংলাদেশ। বরং রোহিঙ্গা ইস্যুটি মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে আন্তর্জাতিক মহলে উত্থাপন করে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে।
সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিবেদনে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। মিয়ানমারকে দেয়া বাজার সুবিধা পুনর্বিবেচনা করতে মানবাধিকার নিয়ে তদন্ত করতে তথ্যানুসন্ধান দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সুনির্দিষ্ট নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এসব পদক্ষেপে বেকায়দায় থাকা মিয়ানমার মানচিত্র নিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করে দৃষ্টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে চাইছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারত থেকে মিয়ানমার বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় সেন্টমার্টিন দ্বীপটি ভারতেই অংশ ছিল। তখনকার মানচিত্রে এই সীমারেখাটি পরিষ্কার। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর সেন্টমার্টিন পাকিস্তানের অংশ হয়। আর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দ্বীপটি বাংলাদেশের মানচিত্রে আসে। এই দ্বীপ কখনোই মিয়ানমারের অংশ ছিল না।
তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সাথে সই হওয়া চুক্তিতে সেন্টমার্টিন দ্বীপটি পরিষ্কারভাবে বাংলাদেশের অংশ ছিল। ২০১২ সালের মার্চে সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে করা মামলার রায়ে সেন্ট মার্টিনকে বাংলাদেশের অংশ হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই এ ব্যাপারে কোনো বিতর্ক থাকতে পারে না। এতো বছর পর তাদের মানচিত্রে দ্বীপটিকে অন্তর্ভুক্ত করা দূরভিসন্ধিমূলক।