সিলেটের ওসমানীনগরে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে পরিকল্পিতভাবে গাড়িচাপা দিয়ে এক মাদরাসা অধ্যক্ষকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিহতের নাম মাও. শায়খুল ইসলাম (৫০)। তিনি উপজেলার বুরুঙ্গাস্থ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মহিলা ফাযিল (প্রস্থাবিত কামিল) মাদরাসার অধ্যক্ষ এবং সুনামগঞ্জ জেলার বিশম্বরপুর থানার নিয়ামতপুর গ্রামের উস্তার আলীর ছেলে। আর এই হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে একই প্রতিষ্ঠানের বাংলা বিভাগের প্রভাষক ও নিহতের সহকর্মী লুৎফুর রহমানের নাম উঠে এসেছে।
এদিকে অধ্যক্ষকে হত্যার পর থেকে পলাতক রয়েছেন মূল অভিযুক্ত লুৎফুর রহমান। তাকে ‘কোথাও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না’ বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, ওসমানীনগর থানা পুলিশ ও শেরপুর হাইওয়ে থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় উপজেলার সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের বুরুঙ্গা সড়কের মুখ সংলগ্ন স্থানে মাও. শায়খুল ইসলাম তার ব্যক্তিগত (নাম্বারবিহীন) মোটর সাইকেলযোগে মাদরাসায় যাওয়ার পথে একই মাদরাসার বাংলা বিভাগের প্রভাষক ও সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ফরিদপুর গ্রামের বাসিন্দা লুৎফুর রহমান (৪৮) পেছন দিক থেকে তার নিজস্ব স্টারলেট গাড়ি (নং- সিলেট-হ-১২-০০৫৫) দিয়ে মহাসড়কের উপর মোটরসাইকেলসহ মাওলানা শায়খুল ইসলামকে চাপা দেন। এতে অধ্যক্ষ শায়খুল ইসলাম ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
এসময় নিহত শায়খুল ইসলামের মোটর সাইকেলে দুমড়ে মুছড়ে যায় এবং প্রভাষক লুৎফুর রহমানের ব্যবহৃত গাড়িটি মহাসড়কে উল্টে যায়। ঘটনাটি দেখে বুরুঙ্গা সড়কের মুখ থেকে ব্যবসায়ীবৃন্দ এবং আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে তাৎক্ষণিক লুৎফুর রহমান মহাসড়কে চলন্ত একটি ট্রাক থামিয়ে ট্রাকে করে সিলেটের দিকে চলে যান।
খবর পেয়ে শেরপুর হাইওয়ে থানা পুলিশ, ওসমানীনগর থানা পুলিশ ও তাজপুর ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিহতের লাশ উদ্ধার করে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে এবং ময়নাতদন্তের জন্যে লাশটি সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। ঘাতক গাড়ির চাপায় মাও. শায়খুল ইসলাম মাথায় মারাত্মক আঘাত পান এবং ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন।
ঘটনার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে নিহতের লাশ একনজর দেখার জন্য ওসমানীনগর থানা চত্বরে হাজির হন তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী মাদরাসার উপাধ্যক্ষ মাও. আহমদ আলী হেলালী, প্রভাষক মাও. ওয়ারিছ উদ্দিন আল মামুন, প্রভাষক ব্যাস বন্ধু পাল, চাতলপাড় দাখিল মাদরাসার সুপার মাও. আব্দুল হাই আল হাদী, মোল্লাপাড়া আহমদিয়া দাখিল মাদরাসার সুপার মাও. আসকর আলী, যুক্তরাজ্য প্রবাসী আলহাজ্ব সুরমান হোসেনসহ নিহতের অনেক সহকর্মী ও শিক্ষার্থীবৃন্দ।
এদিকে নিহতের সহকর্মী ও মাদরাসার আরবী বিভাগের প্রভাষক মাও. ওয়ারিছ উদ্দিন আল মামুন জানান,‘বাংলার প্রভাষক লুৎফুর রহমান নিজেই গাড়ি চাপা দিয়ে অধ্যক্ষকে হত্যা করেছে। অভিযুক্ত লুৎফুর রহমান প্রায়ই মাদরাসায় অনুপস্থিত থাকতেন। তার অনুপস্থিতির জন্য অধ্যক্ষ ৩/৪ দিনের বেতন কর্তন করলে বুধবার সে অধ্যক্ষের উপর ক্ষিপ্ত হয় এবং কথা কাটাকাটি করে। আমরা বিষয়টি তাৎক্ষণিক শেষ করে দেই। অধ্যক্ষের সাথে তার অনেক পুরানো মনোমালিন্য ছিল। পূর্ব শত্রুতার জন্য সে নিজেই গাড়ি চাপা দিয়ে এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।’
ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক ব্যাস বন্ধু পাল জানান,‘বাংলার প্রভাষক লুৎফুর রহমান পূর্বে মাদরাসা থেকে ১৯ মাস বহিষ্কার ছিল। সে ইতোপূর্বে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে। সে মাদরাসায় সময় মতো আসতো না। সম্প্রতি অনুপস্থিতির জন্য তার ৩/৪ দিনের বেতন কাটা হয়ে। বুধবার নতুন রুটিন নিয়ে সে মাদরাসায় অধ্যক্ষের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে কথা কাটাকাটি করে। আমরা বিকালে বিষয়টি মিমাংসা করে দেই। কিন্তু আজ সে তার প্রাইভেটকার দিয়ে অধ্যক্ষকে চাপা দিয়ে হত্যা করেছে।’
মাদরাসার উপাধ্যক্ষ মাও. আহমদ আলী হেলালী বলেন,‘রুটিন নিয়ে মাদরাসায় বুধবার কথা কাটাকাটি হয়েছে। প্রিন্সিপালের সাথে পূর্ব শত্রুতার জন্য প্রভাষক লুৎফুর তার নিজস্ব কার দিয়ে এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। শিক্ষকরা তাকে মোবাইলে কল দিলে কল রিসিভ করে মাদরাসায় আসতে পারবে না বলে জানায়। এতে নিশ্চিত হওয়া যায় সেই হত্যা করেছে।’
নিহতের চাচা শাহ আলম জানান,‘আমার ভাতিজার মাদরাসার সহকর্মীদের কাছ থেকে জেনেছি লুৎফুর নামের এক শিক্ষক আমার ভাতিজাকে কার চাপা দিয়ে হত্যা করেছে। আমরা লাশ নিয়ে মর্গে এসেছি। আমরা হত্যা মামলা দায়ের করবো। আমি আমার ভাতিজা হত্যার বিচার চাই।’
শেরপুর হাইওয়ে থানা পুলিশের (ভারপ্রাপ্ত) ওসি কামরুল ইসলাম বলেন,‘দুর্ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে নিহতের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠিয়েছে। পরিবার এবং স্থানীয়ভাবে শোনা গেছে এটি একটি হত্যাকান্ড। পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দেয়া হবে। হত্যা মামলা হলে বিষয়টি যথা সম্ভব ওসমানী নগর থানা পুলিশ দেখবে।’
ওসমানীনগর থানার ওসি এস এম আল মামুন বলেন,‘দুর্ঘটনার পর নিহত মাওলানার লাশ হাইওয়ে পুলিশ উদ্ধার করেছে। বিষয়টি নিয়ে হত্যার প্রশ্ন উঠেছে। লাশের ময়নাতদন্ত হবে। মামলা হলে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
নিহত মাও. শায়খুল ইসলামের স্ত্রী, ২ মেয়ে ও ১ ছেলে রয়েছে।
নিহত মাও শায়খুল ইসলাম বুরুঙ্গাস্থ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মহিলা ফাযিল (প্রস্থাবিত কামিল) মাদরাসার অধ্যক্ষ হওয়ার পূর্বে গোয়ালাবাজারস্থ ব্রাহ্মনগ্রাম হযরত শাহজালাল (র:) ফাযিল (প্রস্থাবিত কামিল) মাদরাসার আরবীর প্রভাষক ছিলেন। তাছাড়া তিনি গোয়ালাবাজার আদর্শ গণ পাঠাগারের সাথে দীর্ঘদিন জড়িত ছিলেন। সদালাপী হাস্যজ্বল মাওলানার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।