মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকতে হয় মইন উদ্দীনকে

আত্মহত্যা, খুন, পঁচনধরা কিম্বা গলিত-অর্ধগলিত অথবা ক্ষত-বিক্ষত কোনো লাশ বহন করতে ভোগান্তি বা দুশ্চিন্তার কোনো অন্ত নেই। এসব লাশ বহন না করতে থানাপুলিশ কিম্বা গ্রামের গণ্যমান্য লোকজনের ভয়ে পালিয়ে যায় অনেক গাড়িচালক। কিন্তু ময়েন উদ্দীনের ক্ষেত্রে একদম ভিন্ন চিত্র। নওগাঁর রাণীনগরের সিম্বা গ্রামের মইন উদ্দীনই একমাত্র মানুষ যিনি লাশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

মাথায় সাদা টুপি আর পরনে সাদা পাঞ্জাবী মইন উদ্দীনের। রাত হোক আর দিন হোক খবর পেলেই হাজির হয়ে যান লাশ বহন করতে। সেই লাশ মর্গে যাওয়া আবার মর্গে থেকে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত লাশের সাথে থাকেন এই মইন উদ্দীন।

মইন উদ্দীন পেশায় একজন লাশ বহনকারী। তার ক্ষেত্রে লাশ বহন করা একদম নেশা বা পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১৪ বছরে প্রায় ১১০টি লাশ বহন করেছেন তিনি।

কিন্তু ভালো নেই লাশের এই ঘনিষ্ঠ বন্ধু মইন আলী। স্থায়ী কোনো সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় মইন আলীর সংসার চলে জোড়াতালী দিয়ে। মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকতে হয় মইন উদ্দীনকে।

রাণীনগর উপজেলার সিম্বা গ্রামের মৃত আশরাফ আলী মন্ডলের ছেলে মইন উদ্দীন। তিনি জানান, সংসার জীবনে এক মেয়ে, এক ছেলে এবং স্ত্রী নিয়ে অভাব-অনটনের সংসার তার। জীবিকা নির্বাহের জন্য অনেক কষ্ট করে একটি ভটভটি কিনেছিলেন। প্রায় ১৪ বছর আগে ভটভটি চালানো অবস্থায় হঠাৎ একদিন তার গ্রামের একটি লোকের অর্ধগলিত লাশ বাধ্য হয়ে তার গাড়িতে বহন করতে হয়। লাশবাহী গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবতে থাকেন সবাই তো যাত্রী বহন করে, লাশ বহন করার লোক পাওয়া যায় না। লাশ নিয়ে পরিবারের লোকজনদের ও থানাপুলিশদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। পঁচনধরা অর্ধগলিত লাশ গাড়িতে বহন করতে চায় না কেউ। ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত নেয় তিনি শুধুমাত্র লাশ বহন করবেন।

তিনি থানাপুলিশকে বলেন, ‘স্যার লাশ নিয়ে আপনাদের আর কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। আমাকে খবর দিবেন, আমি লাশ বহনের জন্য চলে আসবো।’ সেই থেকে রাণীনগর উপজেলায় ব্যক্তিপর্যায় ও থানাপুলিশের পক্ষ থেকে লাশ বহনের কাজটি মইন উদ্দীনই করে চলেছেন।

লাশের বোঝা টানতে টানতে ধর্মীয় অনুভূতি জাগে মনের মধ্যে। তিনি নামাজ পড়তে শুরু করলেন, মুখে দাঁড়িও রাখলেন। গত ১৪ বছরে তিনি প্রায় ১ শ’ ১০টি লাশ বহন করেছেন।

অজ্ঞাত, পঁচন ধরা, ভাসমান, দুর্গন্ধ হওয়া লাশ, রেল ও সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষত-বিক্ষত হওয়া, হত্যা-আত্মহত্যাসহ সব ধরণের লাশ কাপড় বা চাটাই দিয়ে মোড়ানো ও বহনের ক্ষেত্রে মইন উদ্দীনই যথেষ্ট। ঘটনাস্থল থেকে ময়না তদন্তের জন্য হাসপাতালে নেয়া থেকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা পর্যন্ত লাশের দায়িত্বে থাকতে হয় মইন উদ্দীনকে।

লাশ নিয়ে কাজ করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় অন্য কাজ করতেও মন চায় না মইনের। লাশ বহন করতে পারলেই যেন তার মনে তৃপ্তি আসে। লাশ বহন করে গাড়ি ভাড়া বেশ ভালো পাওয়ার কারণে তার সংসারও বেশ চলছে । লাশ বহনের জন্য তিনি নিজেই তৈরি করেছেন সাদা পোশাক। ঘটনাস্থল যত দূরে, ভাড়াটাও তত বেশি পাওয়া যায়। পঁচনশীল লাশের ক্ষেত্রেও ভাড়া খুব ভালোই হয়। প্রায় দেড় থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত এক একটি লাশের ভাড়া হয়।

এছাড়াও বিপদগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে লাশ বহনের মাধ্যমে এক রকম সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এতে বিপদগ্রস্ত পরিবারের লোকজন তার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন বলে মইন উদ্দীন জানিয়েছেন।

তিনি আরো জানান, সব সময় লাশ বহনের কাজ হয় না। মাসে দু’একটি করে লাশের ভাড়া পাওয়া যায়। তাই অন্য সময় আমার গাড়ি দিয়ে যাত্রী বহন করতে গেলে ‘লাশের গাড়ি’ বলে গাড়িতে কেউ উঠতে চায় না। ফলে মাসের বেশির ভাগ সময় উর্পাজন ছাড়াই বসে থাকতে হয়। তারপরেও শতাধিক লাশ বহন করতে পারায় অনেক আনন্দিত তিনি।

রাণীনগর থানার ওসি এএসএম সিদ্দিকুর রহমান জানান, আমি এই থানায় আসার পর থেকেই দেখছি লাশ বহনের কাজ মইনই করছে। শুনেছি সে দীর্ঘদিন ধরে এই কাজের সাথে জড়িত। থানায় মইনের মোবাইল নাম্বার রাখা আছে। রাত কিম্বা দিন নেই, যখন প্রয়োজন পড়ে তখন মইনকে ফোন করলে হাজির হয়ে যায় মইন উদ্দীন।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top