বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে পররাষ্ট্র দফতর কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানতে চেয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর কাছে মঙ্গলবার চিঠি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি। নির্বাচনে জালিয়াতি, ভোট কারচুপি, ভোটার নির্যাতনের নানা দিক তুলে ধরে এ বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয় ওই চিঠিতে।
মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো বিষয়টি সামনে আসে কমিটির টুইট বার্তায়। পরে অবশ্য হাউজ ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির ওয়েবসাইটে পুরো চিঠিটি প্রেস রিলিজ আকারে প্রকাশ করা হয়। এ দিকে একই দিন যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের আর্মড সার্ভিস কমিটির শুনানিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক দলীয় শাসন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
হাউজ ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানানো হয়, আমরা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নেতিবাচক প্রবণতা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন । ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবের গুরুতর অভিযোগ এ প্রবণতাটিকে আরো শক্তিশালী করেছে। এ নেতিবাচক প্রবণতার বিষয়টি আমলে নিয়ে এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরকে পদক্ষেপ সংবলিত একটি রূপরেখা প্রণয়নের জন্য আমরা অনুরোধ জানাই। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রতি সমর্থন একান্ত জরুরি। সে যাত্রায় বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে ব্যাপকভিত্তিক অনিয়মের প্রতিবেদন বেরিয়েছে, তা মার্কিন স্বার্থের প্রতি চরমভাবে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের এশীয় নীতির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয়, এ বছর এশিয়ায় আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডে সিরিজ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এটা খুব গুরুত্বপূর্র্ণ যে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি তার অব্যাহত অঙ্গীকার ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। যেটি বাংলাদেশ থেকেই শুরু হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের নির্বাচনটিকে একটি বড় মাত্রার জালিয়াতিপূর্র্ণ নির্বাচন আখ্যা দিয়ে এ বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয় ওই চিঠিতে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী ও গর্বিত গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন চলাকালে প্রচারণায় সহিংসতা, গণগ্রেফতার এবং স্বাধীন মত প্রকাশের বিষয়ে আমরা বরাবরই হতাশ ছিলাম। বলা চলে, পুরো নির্বাচনব্যবস্থাটিই হুমকির মুখে পড়েছিল।
আওয়ামী লীগ দাবি করে যে, এ নির্বাচনে তারা ৯৬ শতাংশ আসনে বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার জোট এ নির্বাচনের চেয়েও কম আসনে জিতেছিল। যে নির্বাচনটি দেশের প্রধান বিরোধী দল (বিএনপি) বর্জন করেছিল এবং আওয়ামী লীগ অর্ধেকের চেয়েও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন করেছিল।
ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচন প্রসঙ্গে আরো বলা হয়, যদিও সরকার নিযুক্ত নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে যে, নির্বাচন বৈধ ছিল, তা সত্ত্বেও আমরা বিশ্বাস করি নির্বাচনে ব্যাপকভিত্তিক কারচুপি এবং ভোটারদের দমনের অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা উচিত। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী যখন ভোটগ্রহণ শুরু হয় তখন সন্দেহজনকভাবেই ব্যালট বক্সগুলো ভর্তি পাওয়া যায়। এ ছাড়াও এমন খবরও পাওয়া গেছে- আওয়ামী লীগ কর্মীরা ভোটারদের ভোটপ্রদানে বাধা প্রদান করেছে। দুপুরের খাবারের সময়েই অনেক ভোটকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে অথবা ব্যালট পেপার শেষ হয়ে গেছে। অনেক ভোটার অভিযোগ করেছেন, তাদের ভোট ইতোমধ্যেই দেয়া হয়ে গেছে। নির্বাচনব্যবস্থাটি আরো নাজুক করার জন্য বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাপুষ্ট বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার অ্যাক্রেডিটেশন ও ভিসা প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছে।
মার্কিন কমান্ডারের উদ্বেগ : এ দিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ একদলীয় ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শুনানিতে। মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে সিনেট ভবনে ইউএস ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের কমান্ডার অ্যাডমিরাল ফিলিপস এস ডেভিডসন সিনেটে উপস্থাপিত শুনানিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ সময় শুনানিতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জয় পাকাপোক্ত করে অব্যাহতভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার যে প্রবণতা দেখা গেছে তা উদ্বেগকে সামনে নিয়ে আসে। নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা দেশটিকে কার্যত এক দলের শাসনের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।
শুনানির বাংলাদেশ অংশে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তার বিষয়ে জোর দিয়ে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সাথে আমেরিকান সামরিক বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা, আঞ্চলিক নিরাপত্তাবলয় কৌশল তৈরিসহ বেশ কিছু মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছে।
শুনানিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সাথে মার্কিন সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সৃষ্টি করতে হবে, এটা করতে হবে কৌশলগত বড় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। সেই সাথে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা, প্রতিশ্রুতি পূরণ এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করতে এখানে আঞ্চলিক নিরাপত্তাবলয় তৈরি করতে হবে।’
এশিয়ায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম নিরাপত্তা অংশীদার উল্লেখ করে শুনানিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা অংশীদার। আঞ্চলিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির স্বার্থে এ অংশীদারির গুরুত্ব রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসবাদ দমন, মুসলিম সংখ্যাধিক্য, চরমপন্থা দমন, মানবিক সহায়তা, দুর্যোগ মোকাবেলা আর জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেয়ার কারণে দেশটির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক স্বার্থসংশ্লিষ্টতা রয়েছে।’
রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের প্রসঙ্গে এতে বলা হয়, ‘মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা মানবিক বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে। তাদের নিয়ে বেকায়দায় রয়েছে বাংলাদেশ।’