অধিকতর গতিশীল, সমন্বিত ও জনবান্ধব প্রশাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) ও বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (ইকোনমিক) ক্যাডার একীভূতকরণের নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর গত ১৩ নভেম্বর এর গেজেট প্রকাশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু নানা জটিলতায় এটি প্রকাশের দুই মাস অতিবাহিত হলেও এখনো একীভূতকরণ সম্ভব হয়নি। এতে ইকোনমিক ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর প্রভাব পড়ছে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে।
জানতে চাইল জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহম্মদ নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রশাসনও ইকোনমিক ক্যাডার একীভূতকরণ নিয়ে কাজ চলছে। বিষয়টি এখনো চলমান। আশা করছি দ্রুততম সময়ে এটি নিষ্পত্তি হবে।
সূত্র জানায়, প্রশাসন ও ইকোনমিক ক্যাডারের কাজের ধরন এক। উন্নয়ন প্রকল্পেও এ দুই ক্যাডার কর্মকর্তারা একই রকম অবদান রেখে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। বিশেষ করে ইকোনমিক ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুযোগ কমে গেছে। ফলে এ ক্যাডারের কর্মকর্তারা পিছিয়ে পড়েছেন। এ বিষয়গুলো সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রী এর গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন এবং কথা বলেছেন। পরবর্তীতে বিষয়টি একনেকে প্রধানমন্ত্রীর সভায় উপস্থাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় গত নভেম্বরে গেজেট প্রকাশ করে ইকোনমিক ক্যাডার বিলুপ্ত ঘোষণা করে আইন মন্ত্রণালয়। ফলে এসআরো অনুযায়ী ইকোনমিক ক্যাডারের সমুদয় জনবল প্রশাসন ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হয়।
কিন্তু গেজেট প্রকাশের দুই মাস পেরিয়ে গেলেও আজো জারি করা হয়নি প্রজ্ঞাপন। ফলে ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদবিন্যাস থেকে শুরু করে সব কিছুতে আগের মতো রয়ে গেছে। এতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী একীভূত না হওয়ায় সচিবালয়ে কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিষয়টির সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ হিসেবে সিনিয়রিটি নির্ধারণের বিষয়ে জটিলতার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ইকোনমিক ক্যাডার কর্মকর্তারা বলছেন, ১৯৯২ সালে সচিবালয় ও প্রশাসন ক্যাডার একীভূত করা হয়। সে সময় সরকারকে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। সে সিদ্ধান্তগুলো এখানেও বাস্তবায়ন করলে এটি খুব দ্রুত করা সম্ভব। যে বিষয়টা পিএসসিতে পেন্ডিং আছে সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী এটি বাস্তবায়ন হলে ইকোনমিক ক্যাডার কর্মকর্তারা তাদের পদবি পরিবর্তন করতে পারবেন। এতে কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্থিরতা কেটে যাবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিনিয়র সহকারী প্রধান পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ২৪তম নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা এখন পদোন্নতি পেয়ে উপসচিব হয়েছেন। তারা ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার জন্য পাচ্ছেন ৩০ লাখ টাকার সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা। গাড়ি ব্যবস্থাপনার জন্য পাচ্ছেন ৪৫ হাজার টাকা। কিন্তু একই ব্যাচের ইকোনমিক ক্যাডাররা পদোন্নতি না পাওয়ায় এ সুবিধা হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ ছাড়াও পদবি পরিবর্তনসহ অর্থনৈতিক নানা সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। ফলে কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে।
১৯৯৮ সালে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন নতুন ক্যাডার গঠন না করে ক্যাডারের সংখ্যা কমানোর পক্ষে সুপারিশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে যেসব ক্যাডারের কাজের ধরন একই, সেসব ক্যাডারকে একীভূত করতে সরকারের মধ্যে চিন্তাভাবনা শুরু হয়।
ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তারা দীর্ঘ দিন থেকে প্রশাসন ক্যাডারের সাথে তাদের একীভূতের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এ নিয়ে সরকারের সাথে ইকোনমিক ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের দেনদরবার হয়। দুই ক্যাডারকে একীভূত করতে ২০১০ সালে তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকারের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর দুই ক্যাডার একীভূত করা নিয়ে উভয় ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের মধ্যে সমঝোতা হয়।
২০১৫ সালের ৯ আগস্ট এ বিষয়ে তৎকালীন জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে একটি আধা সরকারিপত্র দেন। সেখানে অর্থমন্ত্রী বলেন, বহুদিন ধরে বিসিএস ইকোনমিক ক্যাডার বিলুপ্তের উদ্যোগ নেয়া হলেও এর কোনো গতি নেই। এ ক্যাডার বিলুপ্ত করে এর সদস্যদের প্রশাসন ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা হলে একটি বড় ধরনের প্রশাসনিক সংস্কার বাস্তবায়িত হবে।
ইকোনমিক ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডারের সাথে একীভূত করতে ২০১৭ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়। ওই বছরের ৩০ মে প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি দুই ক্যাডার একীভূতে সম্মতি দেয়। সর্বশেষ গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইকোনমিক ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডারের সাথে একীভূত করতে অনুশাসন দেন।