ময়মনসিংহের ত্রিশালের শারীরিক প্রতিবন্ধী রওশনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন সোহেল মিয়া, এমন মিথ্যা তথ্য দিয়ে গণমাধ্যমসহ সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের নজর কাড়েন সোহেল মিয়া।
আর গণমাধ্যমও তার তথ্যগুলো যাচাই বাছাই না করে বিশ্ব প্রেমিক হিসেবে উপস্থান করে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের আইটেম স্টোরি করে। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর সোহেল যে লোভে দেখেছিল তার সব কিছুই গুড়েবালি হয়ে যাচ্ছে তার আসল রূপ প্রকাশের মাধ্যমে। ওইসব গণমাধ্যমে তিনি নিজেকে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দাবি করলেও তিনি মূলত অষ্টম শ্রেণি পাশ করেছিলেন।
হ্যাঁ এমনসব তথ্যই ফাঁস করে দিচ্ছেন তার প্রথম স্ত্রী সন্তানরা। ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক প্রতিবন্ধী নারীর প্রেমে পড়ে সুহেল দীর্ঘদিন ধরেই বিবাহিত জীবনযাপন করে আসছে এমন খবর গনমাধ্যমে প্রচারের পর তা দেখে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক নারী সোহেল মিয়াকে তার নিখোঁজ হওয়া স্বামী বলে দাবি করেছেন!
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোহেল এর আগেও একটি বিয়ে করেছিলেন। তার প্রথম স্ত্রী শুরাতন বেগম তিন সন্তানসহ বসবাস করছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বাঙ্গাবাড়ি ইউনিয়নের সন্তোষপুর গ্রামে। ১৬ বছর আগে দাম্পত্য কলহের জেরে কিছু না বলেই বাড়ি থেকে বেড় হয়ে যান সোহেল। এর পর থেকে স্ত্রী সন্তানদের কাছে আর কখনও ফেরে যাননি। এদিকে নিখোঁজ স্বামীর আশায় নতুন করে বিবাহ না করে নিজেই একটি চায়ের দোকান চালিয়ে সংসারের খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন স্ত্রী শুরাতন বেগম। একমাত্র মেয়েকেও বিয়ে করিয়েছেন সংগ্রামী শুরাতন বেগম।
প্রথম স্ত্রী শুরাতন বেগম জানান, স্বামী নিখোঁজ বলেই এতদিন জানতেন। তাদের বিয়েবিচ্ছেদও হয়নি। সম্প্রতি রওশনের সঙ্গে সংসারের খবর সংবাদমাধ্যমে দেখে তিনি এই বিয়ের কথা জানতে পারেন। তবে শুরাতন বেগম আরও জানান, নতুন নামের সোহেল ব্যক্তিটি সোহেল নয়, তার আসল নাম বকুল।
প্রথম স্ত্রী শুরাতন বেগম জানান, মোখলেশুর রহমান বকুলের সাথে বিয়ে হয়েছিল ১৯৯২ সালে। বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন বকুল। অভাবের সংসারে ঋণ শোধের চাপও ছিল। এসব কারণে তাদের মধ্যে কলহ চলছিল। ২০০৫ সালে একদিন কাজের খোঁজে ঢাকায় যাওয়ার কথা বলে বের হন বকুল। তার পর থেকে আজ অবধি ফেরেননি। তিনি ধরে নিয়েছিলেন স্বামী হারিয়ে গেছে।
শুরাতন বলেন, ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালিয়েছি। তবে এখন আর স্বামীকে ফিরিয়ে নিতে চাই না। সে মিথ্যা কথা বলছে, এটা সবাই জানুক। স্বামীকে আমি ফেরত চাই না।
ঘটনাটি জানাজানির পর থেকেই এলাকায় চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। শারীরিক প্রতিবন্ধী নারীকে সরকারিভাবে সহায়তা দেওয়া খুই প্রয়োজন। তবে, স্বামী অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও গণমাধ্যমে বলেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেছেন। এছাড়া তার আগের স্রীসহ ছেলেমেয়ে থাকার বিষয় ও নিজের নাম পরিচয় গোপন রেখে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেলেন। যা অন্যায়!
প্রথম স্রী শুরাতনের বড় ছেলে সিহাব উদ্দীন জানান, সম্প্রতি ফেসবুক ও টেলিভিশনে রওশন-সোহেল দম্পতির খবর দেখে তিনি বাবাকে চিনতে পারেন। নিশ্চিত হতে মা, স্বজন ও এলাকাবাসীদেরও সোহেলের ছবি-ভিডিওগুলো দেখান। এরপর সবাই নিশ্চিত হন- এই সোহেলই সেই বকুল।
এত বছর ধরে বাবা নেই- তাকে ঢাকা খুঁজতে যাননি কেন? এমন প্রশ্নে সিহাব জানান, বাবা যাওয়ার পর থেকে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছিল। ঢাকায় তাকে খুঁজতে যাওয়ার মতো সামর্থ্য তখন ছিল না।
এখন তিনি বাবাকে ফিরে পেতে চান কি না জানতে চাইলে সিহাব বলেন, ‘আমরা কিছুই চাই না। তবে যে মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছে, এটাই দেশবাসীকে জানাতে চাই। তাই কথা বলছি। তিনি আমার বাবা, ছেলে হলেও বলতে হচ্ছে তিনি মিথ্যা বলছেন। সে সেবা করতে সেখানে যায়নি, আসলে সে লুকিয়ে থাকতেই সেখানে গিয়েছে।’
সিহাব আরও জানান, বিভিন্ন খবরে লেখাপড়ার বিষয়ে সোহেল যা দাবি করেছেন, তাও সত্য নয়। সোহেল দাবি করেছেন যে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। তবে সিহাব জানান, তার বাবা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন।
সিহাব প্রশ্ন করেন, ‘যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বাবার, তাদের পরিবার কেন একবারের জন্যেও (সোহেলের) বাবা-মা বা আত্মীয়স্বজন-পরিবারের খোঁজ নেয়নি? তাদের কি একবারও বেড়াতে আসার কথাও মনে হয়নি শ্বশুরবাড়িতে? তাহলেই তো সবকিছু বুঝতে পারত।’
পরিবারটির এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে শুক্রবার সকালে ময়মনসিংহের ত্রিশালের আমিরাবাড়ী ইউনিয়নের গুজিয়াম টানপাড়া গ্রামে রওশন-সোহেল দম্পতির বাড়িতে গিয়ে কথা হয় সোহেল মিয়ার সাথে।
এসময় অভিযোগগুলো জানতে চাইলে সোহেল প্রথমে সব অস্বীকার করেন। পরে সব স্বীকার করে ক্ষমা চান। তিনি জানান, রওশনের প্রতি ভালোবাসা থেকেই অতীত গোপন করেছেন।
একপর্যায়ে প্রতিবেদককে আড়ালে ডেকে নিয়ে সোহেল জানান, এসব মিথ্যা নয়। আগের স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে কলহের জেরে ছেড়ে বাড়ি ছেড়ে এসেছিলেন।
সোহেল বলেন, ‘আমার আগের স্ত্রী-সন্তান আছে। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িনি, মেট্রিক পরীক্ষাই দিইনি। অভাবের মধ্যে ছিলাম। তাই বুঝতে পারিনি যে ভুল করতেছি। ওইখান থেকে আসার পর পঙ্গু মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। অভাবের তাড়নায় মিথ্যা বলেছি। আমি সবার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।’
সোহেল দাবি করেন, রওশনকে বিয়ের পর বিষয়টি আগের স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন। একসঙ্গে সবাইকে নিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। তবে আগের স্ত্রী রাজি না হওয়ায় তিনি আর সেখানে ফিরে যাননি। রওশনকে নিয়ে এই গ্রামেই সংসার পেতেছেন।
সোহেলের স্রী রওশন জানান, তিনি স্বামীর অতীত সম্পর্কে কিছুই জানেন না, জানতেও আগ্রহী নন। এই সংসারেই তিনি সুখী। স্বামীর ভালোবাসায় তিনি কৃতজ্ঞ।
রওশন বলেন, ‘যিনি এসব কথা বলেছেন, মিথ্যা বলেছেন। আমি প্রথম থেকে জানি সে সোহেল রানা। এখন সে (ওই নারী) এসে ভাবছে যে সোহেলের স্ত্রী দাবি করলে হয়তো মিডিয়ার মাধ্যমে অনেক কিছু পাবে। সোহেল ওনার হাজবেন্ড না। এসব মিথ্যা-বানোয়াট।’
এর আগে রওশন-সোহেল দম্পতির ভালোবাসার গল্প ভাইরাল হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের সহায়তা দেয়ার নির্দেশ দেন জেলা প্রশাসককে।
তাদের বাড়িতে গিয়ে বুধবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘এ দম্পতির বিষয়টি জানতে পেরেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সেখান থেকে জেলা প্রশাসক স্যারকে পরিবারটির খোঁজখবর নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’
ইউএনও বলেন, ‘পরিবারটি খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। তবে শত অভাব-অনটনের মধ্যেও তাদের ভালোবাসা অটুট। চোখেমুখে শান্তির ছাপ রয়েছে।
‘তাদের থাকার জন্য সব সুযোগ-সুবিধাসংবলিত একটি পাকা ঘর, শারীরিক প্রতিবন্ধী রওশনের জন্য একটি হুইলচেয়ার, মেয়ের পড়াশোনার খরচসহ একটি ভালো দোকান প্রয়োজন। আশা করছি তারা সরকারিভাবে এসব সহযোগিতা পাবে।’