বাংলাদেশে শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার পর নতুন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ.কে আবদুল মোমেন এই প্রথম দিল্লি সফর করে গেলেন৷ শেখ হাসিনার কি বার্তা নিয়ে এসেছিলেন তিনি? দিল্লির কূটনৈতিক অলিন্দে যে কথাটা ঘোরাফেরা করছে তা হলো, ভারতে সাধারণ নির্বাচন যখন দরজায় কড়া নাড়ছে. কোন দল সরকার গড়তে পারবে, তা যখন অনিশ্চিত, তখন সরকারি আশ্বাসের দাম কতটা? সমীক্ষার হিসেব বলছে, বিজেপি, কংগ্রেস এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের মহাজোট একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গড়ার ক্ষেত্রে সংশয় আছে৷ সেই সময়ে সরকারি আশ্বাসের দাম কতটা? তবে যে দলই সরকার গঠন করুক, অন্য দলের সঙ্গে হাত মেলাতে হবে৷ সেক্ষেত্রে ভারতের পররাষ্ট্র নীতির অভিমুখ কোন দিকে হবে সেটাও এই মুহূর্তে বলা মুশকিল৷
এমন একটা সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন হাসিনার কী বার্তা দিয়ে গেলেন ভারতকে?বলা বাহুল্য, দুই দেশের ঐতিহাসিক সহযোগিতার পরম্পরা বজায় রাখার বার্তা৷ নির্বাচনে যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন৷ সেটা মাথায় রেখেই বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবদুল মোমেন সাবেক কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন৷ তাত্পর্যপূর্ণ হলো, মনমোহন সিং জানিয়েছেন, যে দলই সরকারে আসুক রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কংগ্রেস সব সময়েই বাংলাদেশের পাশে আছে এবং থাকবে৷
শেখ হাসিনা সরকার দিল্লির দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে কখনো কার্পণ্য করেননি৷ কিন্তু দুটি ইস্যুতে কিছুটা টানাপোড়েন চলছিল সম্প্রতি৷ এক, রোহিঙ্গা ইস্যু, দুই, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন৷ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যাতে দ্রুত মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়, তার জন্য ভারতের আরো বেশি সহযোগিতা দরকার, সেটা প্রধানমন্ত্রী মোদিকে জানালেন মোমেন৷ জানালেন শীর্ষ স্তরে মিয়ানমার সরকারের উপর আরো বেশি চাপ সৃষ্টি করা দরকার৷ মোদি নিজেও জানিয়েছেন, দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্কের মডেল হলো দিল্লি-ঢাকা সম্পর্ক৷ গোটা বিশ্বের পক্ষে তা অনুকরণযোগ্য৷
এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইন্দ্রানী বাগচি ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘বাংলাদেশ চাইছে ভারত সরকার যেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারের উপর আরেকটু বেশি চাপ দেয়, যাতে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটা আরেকটু সহজ হয়৷ ঢাকা মনে করে, ভারত এবং চীন মিয়ানমারের ওপর যথেষ্ট প্রেশার দিলে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে পারে৷ এখনো পর্যন্ত সেই প্রেশার দেয়া হয়নি৷ তবে ভরত এর বেশি কিছু করতে পারে না৷”
তিনি আরো বলেন,‘‘তিস্তার জলবণ্টন ইস্যু বাংলাদেশের একটা রাজনৈতিক ইস্যু৷ভারতে রাজনৈতিক ইস্যু নয়৷ তিস্তা নিয়ে যে ভারতের অবস্থান পাল্টাবার নয়, সেটা উভয় দেশই জানে৷ তবে তিস্তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় যেটা বলেছিলেন, জলবণ্টনই যদি ইস্যু হয়, তাহলে শুধু তিস্তা নদী কেন, আরো তিনটি নদী আছে৷ সেইসব নদীর জল শেয়ার করা যেতে পারে৷ দ্বিতীয়ত, পলিমাটিতে তিস্তার নদীর নাব্যতা এবং গভীরতা কমে গেছে৷ এমন নয় যে মমতা বাংলাদেশকে পানি দিতে চায় না৷”
ভারতে নির্বাচনের সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দিল্লি সফরের যৌক্তিকতা কতটা? ইন্দ্রানী বাগচি মনে করেন, ‘‘একটা কূটনৈতিক প্রেশার জিইয়ে রাখা, যাতে নতুন সরকারের উপর গোড়া থেকেই এই নিয়ে চাপ বাড়ানো যায়৷ কারণ, ঢাকাও জানে, নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে দিল্লির পক্ষে বিশেষ কিছু করা সম্ভব নয়৷ তার উপর মোদি-মমতার তরজার রাজনৈতিক আবহে দুজনের সম্পর্ক তলানিতে৷ একে অপরের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে৷ কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় এলে এই দুটি ইস্যুর সমাধান করে দেখাবে বলে মনমোহন সিং যা বলেছেন, সেটা সরকারবিরোধী দলের নেতা হিসেবেই বলেছেন৷ ওটা বলতেই হয়৷ মোট কথা, গ্রহণযোগ্য সমাধান আপাতত কিছু দেখা যাচ্ছে না৷ একটা সার্বভৌম দেশ, মানে মিয়ানমার যদি রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে না চায়, তাহলে জোর করে তো কিছু করা যাবে না৷ সেটা তো মানতে হবে, তাই না ? কংগ্রেস যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে বুঝতে পারবে, যেটা তারা আগেও বুঝেছিল যে, দিল্লি মিয়ানমারের উপর খুব বেশি প্রেশার দিতে রাজি নয়৷”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে পঞ্চম যৌথ পরামর্শদাতা কমিশন (জেসিসি)-র বৈঠকেও তিস্তার প্রসঙ্গ তুলেছেন আবদুল মোমেন৷ তিনি জানালেন, তিস্তাসহ দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলির জলবণ্টন নিয়ে এক সামগ্রিক চুক্তি সই হোক৷ পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়েও তিনি মত বিনিময় করেন ভারতর পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে৷ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, এই ধরনের চুক্তি যাতে দ্রুত সম্পন্ন হয়, তার আশ্বাস দিয়েছেন সুষমা স্বরাজ৷ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নেবার বিষয়ে তিনি মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চির সঙ্গে কথা বলবেন৷
বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী তার ইনিংস শুরু করতে না করতেই তিস্তা ইস্যুকে ফের আলোচনার টেবিলে এনে বাংলাদেশের মানুষের কাছেও হাসিনা সরকারের ইতিবাচক বার্তা দিতে চাইলেন৷ দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের পর সই হয় চারটি সমঝোতাপত্র৷ মংলায় ভারতের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, দুর্নীতি দমনে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং প্রশিক্ষণ, ভেষজ ক্ষেত্রে সমঝোতা এবং সরকারি অফিসারদের প্রশিক্ষণ৷ ভারত ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ (লাইন অফ ক্রডিট) দেবে৷ বাংলাদেশের তরফে জানানো হয়, মোমেনের এই দিল্লি সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে