হু হু করে বাড়ছে সাবান, শ্যাম্পু হ্যান্ডওয়াশের দাম

প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে কোনো না কোনো পণ্যের দাম। খাদ্যদ্রব্যের পাশাপাশি লাগামহীনভাবে বাড়ছে মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্যের দামও।

বছরজুড়েই সাবান, শ্যাম্পু, হ্যান্ডওয়াশ, টুথপেস্ট থেকে শুরু করে সব ধরনের নিত্য ব্যবহৃত পণ্যের দাম দফায় দফায় বেড়েছে। গত এক মাসেই এসব পণ্যের দাম বেড়েছে অন্তত ১০ শতাংশ। প্রকারভেদে ১/২ মাসের ব্যবধানে সর্বনিম্ন ২-৩ টাকা থেকে ১০-২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বিদেশি কোম্পানি ইউনিলিভারের পথ ধরেই অন্য কোম্পানি তাদের পণ্যের দাম দফায় দফায় বাড়িয়েছে। কিছু পণ্যের দাম না বাড়ালেও পরিমাপে কমিয়ে দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করছেন বিক্রেতারা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপের মধ্যেই এসব পণ্যের বাড়তি দামের কারণে জীবন যাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।

বিক্রেতারা বলছেন, খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে সরকারের তদারকির ব্যবস্থা থাকলেও দৈনন্দিন ব্যবহৃত এসব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারে কোনো নজরদারি নেই। ফলে দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর জবাবদিহিও করতে হচ্ছে না কারও কাছে।

ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে সাবান, শ্যাম্পু, হ্যান্ডওয়াশ, টুথপেস্টসহ সব পণ্য কিনতে হচ্ছে বাড়তি দামে। অনেকদিন ধরেই এসব পণ্যের বাজার দখল করে আছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড। তবে ইদানীং তাদের পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে চলেছে বিদেশি এই প্রতিষ্ঠানটি। মূল্য সমন্বয় করতে ইউনিলিভারের দেখাদেখি অন্য কোম্পানিগুলোও দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এক মাস আগেও ইউনিলিভারের পণ্য লাইফবয় হ্যান্ডওয়াশের দাম ছিল ৬০ টাকা। তা এখন ৫ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬৫ টাকা। ১ কেজি ওজনের কাপড় কাঁচা হুইল গুঁড়া সাবানের দাম ছিল ৯০ টাকা, এখন সেটি ১০ টাকা বৃদ্ধি করে ১০০ টাকা করা হয়েছে। একইসঙ্গে ১০ টাকা বাড়িয়ে ১২০ টাকা মূল্যের রিন গুঁড়া সাবানের মূল্য ১৩৫ টাকা ধরেছে ইউনিলিভার। কেজিতে ১০ টাকা বৃদ্ধি করেছে সার্ফ এক্সেলের দামও। এখন এক কেজি ওজনের সার্ফ এক্সেল বিক্রি হচ্ছে ২১০ টাকায়। এ ছাড়াও, ইউনিলিভারের সব ধরনের সাবানে প্রকারভেদে ৫-১০ টাকা বেড়েছে। মাসখানেক আগেও যে সাবানটির মূল্য লেখা ছিল ৩০-৩২ টাকা, এখন সেটি হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। কোম্পানিটির মাঝারি সাইজের লাক্স সাবানের মূল্য ছিল ৩২ টাকা, এখন সেই সাবান বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকা। আর বড় সাইজের লাক্স বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা, যা আগে ছিল ৪৫ টাকা। লাইফবয় সাবান যেটার মূল্য ছিল ৩২ টাকা, এখন সেটি ৩৮ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে বিক্রেতাদের। আর বড় সাইজের লাইফবয় এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়, যা আগে ছিল ৪২ টাকা। স্যান্ডেলিনা সাবানেও ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। বিক্রেতারা জানান, থালাবাসন পরিষ্কারে ব্যবহৃত ভিম সাবানের দাম বাড়ানো না হলেও ওজনে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। আগে ৩২ টাকা দামের ভিম যেখানে ৩৩০ গ্রাম ওজনের ছিল, সেটি এখন কমিয়ে ৩০০ গ্রাম করা হয়েছে। এ ছাড়া ইউনিলিভারের পন্ডস ফেসওয়াশ ও ত্বকে মাখানো ক্রিমেও ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। কোম্পানিটির ৩৫০ গ্রাম ওজনের সানসিল্ক শ্যাম্পুর দাম বেড়েছে ১০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৩০ টাকা। এক মাসেই ১৮০ মিলি ওজনের সানসিল্ক শ্যাম্পুর দাম বেড়েছে ১৫ টাকা, এখন যা বিক্রি হচ্ছে ১৮৫ টাকা। কোম্পানিটির ২০০ গ্রাম ওজনের ক্লোজআপ টুথপেস্টের দাম ১০ টাকা বৃদ্ধি করে ধরা হয়েছে ১২০ টাকা, যা এক মাস আগেও ছিল ১১০ টাকা। পেপসোডেন্ট টুথপেস্ট আগে যেটার দাম ছিল ১২০ টাকা, এখন তা ধরা হয়েছে ১৩০ টাকা। এ ছাড়াও মুখের ক্রিম ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির দামও বেড়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা। এভাবে প্রায় অধিকাংশ পণ্যের দাম বৃদ্ধি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কোনো পণ্যের দাম না বাড়লেও ওজনে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের পথ ধরেই প্রায় সব কোম্পানিই এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধি করেছে।

মুদি দোকানি রিয়াদ হোসেন বলেন, গত এক বছর ধরেই ইউনিলিভারের সব পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। তাদের দেখাদেখি অন্য কোম্পানিও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এক মাসের মধ্যেই সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্টের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। রাজধানীর কচুক্ষেত বাজারে আরেক ব্যবসায়ী রতন আলী বলেন, প্রতিনিয়তই দাম বাড়ছে। কিছু পণ্যের দাম এক লাফে অস্বাভাবিক বেড়েছে। এতে ক্রেতারা যেমন সমস্যায় পড়েছে, তেমনি আমরাও বিপদে আছি। কোম্পানি দাম বাড়ালেও কাস্টমারদের কাছে জবাবদিহি করতে হয় আমাদের। আর আমরাও তো সাধারণ ভোক্তা। আমাদেরও তো বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে।

কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে সরকার যেভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে, এসব পণ্যের ব্যাপারে সেভাবে কিছু করার থাকে না। তবে, সার্বিকভাবে দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণেই দ্রব্যমূল্যের পাশাপাশি এখন এ জাতীয় পণ্যের দামও বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, এ ছাড়া সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে বলেও মনে হচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে সব জিনিসের দাম বাড়ছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এসব পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলেও মত দেন ক্যাব সভাপতি। বলেন, সরকারের সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। জোর করে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করাটা মুক্ত বাজার অর্থনীতির সঙ্গে যায় না। যেসব পণ্যের দাম বাড়ছে এগুলো কিন্তু বাজারের একক কোনো পণ্য না। এখানে অনেক প্রতিযোগিতা আছে। এখন উৎপাদক তার উৎপাদন খরচ বিবেচনায় অথবা বেশি লাভ করতে গিয়ে যদি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়; আর ভোক্তাও যদি সেটি ক্রয় করে, তাহলে এখানে আর কিছু করার থাকে না।
গোলাম রহমান বলেন, বাজারে প্রভাবশালী কোম্পানি যখন দাম বাড়ায়, তখন অন্যরাও সেটা ফলো করে, এটা স্বাভাবিক। তবে এটি সার্বিকভাবে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধিরই একটা প্রভাব। তিনি বলেন, খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়লে সরকার এটার সরবরাহ বাড়াতে পারে, অথবা সরকারি সংস্থাগুলো সাশ্রয়ী মূল্যে তা ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করতে পারে। কিন্তু এসব পণ্য তো সরবরাহ বাড়ানোর কিছু নেই। এটা সম্পূর্ণ উৎপাদকদের হাতে। সরকার চাইলে শুধু মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, ট্যাক্স কমিয়ে দিতে পারে কিংবা ভ্যাট কমানোসহ নানা উদ্যোগ নিতে পারে।

ভোক্তা অধিকার সংস্থা কনসাস কনজ্যুমার্স সোসাইটি (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির স্রোতে মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহৃত পণ্যেরও দাম বাড়াচ্ছে কোম্পানিগুলো। এ নিয়ে কারও কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সাধারণ মানুষ এমনিতেই খাদ্যদ্রব্যের বাড়তি দামে দিশাহারা। এই অবস্থায় এসব পণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধিতে আরও চাপে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। সরকারের উচিত সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া।

Share this post

scroll to top