সোমেশ্বরীতে বালুমহলের ইজারা বন্ধে বেলার আইনি নোটিশ

পাহাড়ি খরস্রোতা নদী সোমেশ্বরী। প্রাকৃতিক নানা খনিজ সম্পদে ভরপুর ও স্বচ্ছ পানির এই নদী খ্যাতি ছড়িয়েছে সারাদেশে। সোমেশ্বরীর সিলিকন বালু নদীর বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে কয়েকগুণ। তবে এই বালু ঘিরেই তৈরি হয়েছে বালুখেকোদের মহা তান্ডব। বালু সবার কাছে এক সময় আশীর্বাদ থাকলেও এখন অভিশাপ। এই বালুর কারণেই পযটন এই নগরির স্বাভাবিক জীবন যাত্রা।

প্রতিবছরই জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে নামমাত্র পাঁচটি বালু মহল ইজারার দিয়ে নদীর পাশাপাশি ধ্বংস করা হচ্ছে পুরো উপজেলাকে। ২০১০ সাল থেকে শুরু হওয়া বালু উত্তোলনে এখন ধ্বংস পুরীতে রূপ নিয়েছে সোমেশ্বরী। গত ১১ বছরের নদীর জীববৈচিত্র্য, মৎস্য সম্পদ থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক সবকিছুই নিঃশেষের পথে।

নদীকে ঘিরে গড়ে উঠা সুসং দুর্গাপুরের পর্যটন খাত আজ মাথা তুলে দাঁড়াবার আগেই হোঁচট খাচ্ছে বারবার। দূরদূরান্ত থেকে স্বচ্ছ নদীর পানি টানা ছুটে আসা ভ্রমণপিপাসুরা পাচ্ছে বালুখোকোদের তাÐবের নীলা। প্রতি বছর শীতের মৌসুমে নদীতে হাজারো অতিথি পাখির অবাধ বিচরণ ছিলো। আজ সেই একই বালুতটে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হাজারো নিষিদ্ধ বাংলা ড্রেজার। পাখির কলকাকলি শব্দের পরিবর্তে কানে ভাসে ড্রেজারের কানফাটা শব্দ।

অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র নিষিদ্ধ ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে তা আবারও পরিবহন করা হচ্ছে পুরোপুরি অপরিকল্পিতভাবেই। নদী ৫০-৭০ ফুট ভূগর্ভস্থ থেকে নিষিদ্ধ পাম্প ও ড্রেজার মেশিনে বালু উত্তোলন করে ট্রাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। দীর্ঘদিনেএসব ট্রাকগুলো চলাচল করে আসছে দ্বিতীয় শ্রেণার পৌর শহরের ভিতর দিয়ে। ফলে শীত-গ্রীস্ম ও বর্ষা সবসময়ই কাদায় ভেসে থাকে পুরো সড়ক।

সোমেশ্বরীতে বালুখেকোদের দৌরাত্ম নিয়ে বারবার বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ প্রচারিত হলেও অজ্ঞাত কারণে নিশ্চুপ সবাই। স্থানীয়রাও প্রতিবাদ আন্দোলন করে বারবার আশ্বাস ছাড়া ভাগ্যে জোটেনি করে কিছুই। তবে স¤প্রতি বিষয়টি আবারো নজরে এনেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।

বালুখেকোদের থেকে সোমেশ্বরীরকে বাঁচাতে বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের একটি আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন বেলা। গত ২৩শে জানুয়ারী বেলার পক্ষে আইনজীবী এস হাসানুর বান্না আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে ডাকযোগে নোটিশটি প্রেরণ করেন।
এই নোটিশে ভূমি মন্ত্রণালয় সচিব, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় সচিব, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সচিব, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান, ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক, নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক, নেত্রকোনা পুলিশ সুপার, দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার, দুর্গাপুর পৌর মেয়র আলা উদ্দিন আলাল সহ ১২ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে।

এই নোটিশে বলা হয়েছে, পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) নেত্রকোনার দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদী রক্ষা ও নদীতে বালুমহাল ইজারা প্রদানসংক্রান্ত বিষয়ে ২০১৫ সালে একটি জনস্বার্থমূলক মামলা করে (নং৫৩৩২/২০১৫)। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সোমেশ্বরী নদী থেকে বালু ও পাথর উত্তোলন ও নিয়ন্ত্রণ এবং বালু, পাথর ও মাটি উত্তোলনে পাম্প ও ড্রেজার মেশিন ব্যবহার কঠোরভাবে প্রতিরোধ সহ নিয়মিত তদারকিতে বিবাদীদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নের অনুরোধ জানিয়ে বারবার নোটিশ প্রেরণ করা হলেও সোমেশ্বরী নদী থেকে বালু উত্তোলনের বর্তমান চিত্র বিবাদী কর্তৃক আইন প্রয়োগে ব্যর্থতার ও আদালতের আদেশের প্রতি চরম অবজ্ঞা ও উদাসীনতার পরিচায়ক।

নোটিশে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি সোমেশ্বরী নদীতে ঘোষিত বালুমহাল থেকে বালু ও পাথর উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ এবং বালু, পাথর ও মাটি উত্তোলনে পাম্প ও নিষিদ্ধ ড্রেজার মেশিনের ব্যবহার কঠোরভাবে প্রতিরোধের দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে নদী ও নদীসংলগ্ন জনবসতির বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় বালুমহাল ইজারার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পুনরায় ইজারা প্রদান থেকে বিরত থাকতে এবং প্রয়োজনে বালুমহাল বিলুপ্তি ঘোষণা করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। সাথে আগামী ২৭শে জানুয়ারি মধ্যে গৃহীত পদক্ষেপ উপস্থাপনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এদিকে আইনি নোটিশ প্রচারের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে দুর্গাপুর উপজেলার সর্বস্তরের মানুষের মাঝে স্বস্তির নিঃশ্বাস বয়ে। দীর্ঘদিন ধরে ভোগান্তির শিকার সোমেশ্বরী পাড়ের বাসিন্দারা নদীর বালুমহল ইজারা পুনরায় না দিয়ে পুরোপুরি বিলুপ্তি ঘোষণা করা এখন সময়ের দাবি বলে জানিয়েছেন তারা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই নদীর সৌন্দর্যকে তুলে ধরতে এবং নদীরে সৌন্দর্য পুনরায় আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে সোমেশ্বরীতে বালু উত্তোলন বন্ধ করাই একমাত্র পথ বলে মনে করনে স্থানীয়রা।

Share this post

scroll to top