পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলে সাত জেলার নৌকা প্রতীকের বড় বিপর্যয় হয়েছে। ওইসব জেলায় চেয়ারম্যান পদে ভোটের লড়াইয়ে দলীয় প্রার্থীর চেয়ে তুলনামূলক বেশি ব্যবধানে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন।
জেলাগুলো হচ্ছে-নীলফামারী, জয়পুরহাট, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর। এছাড়া আরও ১৫ জেলার নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের তুলনায় স্বতন্ত্ররা বেশি সংখ্যক ইউনিয়ন পরিষদে জয় পেয়েছেন।
বিদ্রোহীদের দাপট, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও অজনপ্রিয়দের মনোনয়নের কারণে মূলত আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা হেরেছেন বলে মনে করছেন দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। কোথাও কোথাও নৌকার প্রার্থীদের জয়ের বিষয়ে অতিবেশি আত্মবিশ্বাসও পরাজয়ে নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছে।
গত বুধবার ৪৮ জেলার ৭০৭টি ইউনিয়ন পরিষদে এ ধাপে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, পঞ্চম ধাপে আওয়ামী লীগের চেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেশি সংখ্যক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। এ ধাপে ৭০৭টির মধ্যে ৬৯২টি ইউনিয়ন পরিষদের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। বাকি ১৫টির ফল স্থগিত রয়েছে। ফল ঘোষিত ইউনিয়ন পরিষদগুলোর মধ্যে ৩৪৬টিতে (একজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীসহ) স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জিতেছেন ৩৪১টিতে। তাদের মধ্যে ৪৬ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ফলাফল বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর- এই চারটি জেলার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কাউকেই মনোনয়ন দেয়নি।
ওইসব জেলায় দলটির প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ চারটি জেলায় ৪৯ জন স্বতন্ত্রভাবে জয়ী হয়েছেন। এ সংখ্যা যুক্ত করলে আওয়ামী লীগের জয়ের পাল্লা ভারি হয়।
প্রসঙ্গত, এ পর্যন্ত পাঁচ ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত চেয়ারম্যান পদের আনুষ্ঠানিক ফলাফলে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ভোটে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা এগিয়ে ছিলেন। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপে নির্বাচন কমিশনের ভাষায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেশি ইউনিয়ন পরিষদে জয় পান।
পঞ্চম ধাপের ফল বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, যে চারটি জেলায় আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয়নি সেগুলো বাদেই বাকি ২২টি জেলায় দলীয় প্রার্থীর চেয়ে স্বতন্ত্ররা বেশি ইউনিয়ন পরিষদে জয় পেয়েছেন। এর মধ্যে সাতটিতে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয়ের ব্যবধান অনেক বেশি। বাকি ১৫টিতে অল্প ব্যবধানে স্বতন্ত্ররা এগিয়ে রয়েছেন।
ওই ১৫টি জেলা হচ্ছে-কুড়িগ্রাম, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, ঝিনাইদহ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, নেত্রকোনা, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, সুনামগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা ও বান্দরবান। এ ধাপের বাকি ২২টি জেলায় স্বতন্ত্রদের চেয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা এগিয়ে রয়েছেন। ফেনীর সবকটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জিতেছেন।
আরও দেখা গেছে, হবিগঞ্জের চুনারাঘাট ও মাধবপুর উপজেলার ২১টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন হয়। এর মধ্যে ছয়টিতে নৌকা প্রতীক ও ১৫টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হন। এ জেলায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রার্থী এতই কম ভোট পেয়েছেন যে তাদের জামানতও রক্ষা করতে পারেননি।
স্থানীয় সূত্র জানা গেছে, স্বতন্ত্রভাবে জয়ী ১৫ জনের ৬ জনই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী, ৭ জন বিএনপির, একজন জামায়াত ও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. আলমগীর চৌধুরী বলেন, কেন্দ্র থেকে যেভাবে নির্দেশনা এসেছে সেভাবেই নৌকার প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করেছি। কিন্তু প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় আমাদের প্রার্থীদের এই পরাজয় হয়েছে।
রাজশাহীর বাগমারা, দুর্গাপুর ও পুঠিয়া উপজেলার ১৯টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হয়। এর মধ্যে ১৮টির ফল পাওয়া গেছে। সেগুলোর মধ্যে ৬টিতে নৌকা ও ১২টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ১২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী সাতজন ও বিএনপির পাঁচজন চেয়ারম্যান রয়েছেন।
এ জেলায় নৌকা প্রার্থীদের এমন ভরাডুবির বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিক কুমার সরকার বলেন, প্রার্থী মনোনয়নে অনেক ক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি। এ নিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। এ কারণে অধিকসংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী জয় পেয়েছেন।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে ১০টিতে দলটির প্রার্থীরা হেরে গেছেন। একমাত্র গোস্বামী দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. লাল্টু রহমান চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এ জেলায় জয়ী ১০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর ৮ জনই ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী। বাকি দুইজন স্বতন্ত্র।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী বলেন, প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। যারা মনোনয়ন পেয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী কাজ করায় বিদ্রোহীরা জয় পেয়েছেন।
এছাড়া নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ ও ডোমার উপজেলায় ১১টি ইউনিয়ন পরিষদে এ ধাপে ভোট হয়। এর মধ্যে তিনটিতে নৌকা প্রার্থী জিতেছেন। বাকি আটটিতেই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। তাদের মধ্যেই সাতজনই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী।
জয়পুরহাট জেলায় পাঁচটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মধ্যে চারটিতেই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন। বাকি একটিতে জিতেছেন নৌকার প্রার্থী। একইভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সদর উপজেলায় ১২টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিতেছেন ৬টি ইউনিয়ন পরিষদে।
চাঁদপুরের কচুয়া, ফরিদগঞ্জ ও হাইমচর উপজেলায় ২৯টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হয়। এ জেলায় বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী একজনসহ মোট ১০ জন আওয়ামী লীগের প্রার্থী জিতেছেন। অপরদিকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছেন ১৯ প্রার্থী।