শীতল হাওয়ার পরশে সোনামণিরা এখন খুব বেশি শ্বাসকষ্টসহ সর্দি কাশিতে ভুগছে। এ সর্দি কাশিকে নিউমোনিয়া ভেবে অনেকেই বাচ্চাকে অহেতুক এন্টিবায়েটিক খাওয়াচ্ছেন। এতে বাচ্চার লাভ তো হয়ই না বরং অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিকের কারণে ক্ষতি হয়। এ সময় বাচ্চার শ্বাসকষ্টের প্রধান কারণ ব্রঙ্কিওলাইটিস। ব্রঙ্কিওলাইটিস একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এ ভাইরাসটি নাকের শ্লেষ্মা পরীক্ষা করে পাওয়া যায়।
ভাইরাসটির নাম রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস (আরএসভি), আমাদের দেশে এ পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। তবে রোগ নির্ণয়ের জন্য মনে রাখতে হবে, দুই বছরের নিচের শিশুর নাকে সর্দির পরে কাঁশি ও শ্বাসকষ্ট হলে ব্রঙ্কিওলাইটিস হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে, যদি অন্য কোনো রোগ মনে না হয়। এ শিশুরা দ্রুত সুস্থ হয় এবং হাসতে থাকে। তাই হাসি, কাঁশি এবং বুকের বাঁশি-ই ব্রঙ্কিওলাইটিস।
শীতকালে বারবার শিশুদের শর্দিকাশিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা।
সারা দেশের ৪৩টি হাসপাতালে পাঁচ হাজারের অধিক পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুর মধ্যে গবেষণা করে দেখা গেছে, শতকরা ২১ ভাগ শিশু ব্রঙ্কিওলাইটিসে আক্রান্ত হয় এবং ১১ ভাগ শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ থেকে প্রমাণিত হয়, ছোট্ট শিশুদের শ্বাসকষ্টের প্রধান কারণ ব্রঙ্কিওলাইটিস, নিউমোনিয়া নয়।
আমাদের শরীরের বুকের মধ্যে দুইদিকে দুটি ফুসফুস আছে যা একটি উল্টানো গাছের মতো। গাছের কাণ্ড থেকে শাখা-প্রশাখা বিস্তারিত হয়ে পাতায় শেষ হয়। এ গাছের কাজ হল আমাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করা। পাতার বোঁটায় প্রদাহ হলে (ভাইরাসের কারণে) এটাকে বলে ব্রঙ্কিওলাইটিস এবং পাতায় প্রদাহ হলে নিউমোনিয়া। সুতরাং দুটি এক অসুখ নয়। ব্রঙ্কিওলাইটিস ছোট্ট শিশুদের (<২ বছর) হয়ে থাকে, নাক দিয়ে পানি পড়ার পর কাঁশি ও শ্বাসকষ্ট হয়, জ্বরের মাত্রা কম থাকে, বুকে বাঁশির মতো আওয়াজ হয় এবং শিশু তিন-চার দিনের মধ্যে সুস্থ হয় কিন্তু ভবিষ্যতে আবারও আক্রান্ত হতে পারে।
নিউমোনিয়া যে কোনো বয়সে হতে পারে। শিশুর খুব জ্বর হয়, অসুস্থতা চেহারায় প্রতিফলিত হয়, কাঁশি, শ্বাসকষ্ট হয় ও বুকে স্টেথোস্কোপ দিয়ে বিশেষ আওয়াজ পাওয়া যায়। বুকের এক্স-রে করলে কালো ফুসফুসে বিভিন্ন আকৃতির সাদা সাদা দাগ দেখা যায়। রক্ত পরীক্ষাতে শ্বেতকণিকার মাত্রা বেড়ে যায়। সেরে উঠতে সময় লাগে এবং একবার ভালো হলে সাধারণত আর হয় না। এ অসুখে শিশু দ্রুত সুস্থ হয়। ব্রঙ্কিওলাইটিস রোগ নির্ণয়ের জন্য সাধারণত কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। রক্তের শ্বেতকণিকার মাত্রা স্বাভাবিক থাকে। বুকের এক্স-রে করা যেতে পারে যেখানে ফুসফুসে বেশি বাতাস আটকে থাকার লক্ষণ যেমন- বেশি বড় এবং বেশি কালো ফুসফুস আমরা দেখতে পাই।
ব্রঙ্কিউলাইটিসের চিকিৎসা : ব্রঙ্কিউলাইটিসে কিন্তু বেশিরভাগ শিশুকে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করা যায়। তবে সুস্থ শিশুদের ব্রঙ্কিউলাইটিসে আক্রান্ত শিশু থেকে সরিয়ে রাখতে হবে। দিনের বেলায় রোদ উঠলে বাচ্চাকে খোলামেলা জায়গাতে রাখুন। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল আর নাক বন্ধ হয়ে গেলে নরমাল স্যালাইন (লবণপানি) ব্যবহার করা যেতে পারে। ভাইরাসজনিত এই রোগে অ্যান্টিবায়োটিক লাগে না। শ্বাসকষ্ট খুব বেশি হলে, বাচ্চা অজ্ঞান হয়ে গেলে, খিঁচুনি হলে, ঠোঁট নীল বা কালো হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি নিশ্চিত করা গেলে এবং সেই সঙ্গে ৩ শতাংশ সোডিয়াম ক্লোরাইড দিয়ে নেবুলাইজ করলে বেশিরভাগ বাচ্চাই ভালো হয়ে যায় । এ ক্ষেত্রে সালবিউটামল বা স্টেরয়েড দিলে খুব একটা উপকার পাওয়া যায় না।
প্রতিরোধ : বাচ্চার বুকে বা মাথায় ভিক্স, বাম দেয়া যাবে না। অহেতুক নেবুলাইজার কিংবা যন্ত্রের সাহায্যে কফ পরিষ্কারের নামে সাকশান দেয়ারও প্রয়োজন নেই। এ সময় তরল খাবার, বিশেষ করে বুকের দুধ ঘন ঘন খাওয়াতে হবে। খুব বেশি কাশি না হলে সপ্তাহে ২-১ বার গোসল করাতে পারবেন, অন্য সময় কুসুম গরম পানিতে পাতলা কাপড় ভিজিয়ে শরীর মুছে দিন। শিশুকে সিগারেট, মশার কয়েল ও রান্নাঘরের ধোঁয়া থেকে দূরে রাখুন। বাচ্চাকে কোলে নেয়ার আগে ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধুলে এবং সেই সঙ্গে দুই বছর বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ নিশ্চিত করা গেলে এ রোগ উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব।