লক্ষ্য অর্জনে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশকে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ তথা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে ব্যক্তির ওপর চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ কমাতে হবে। এজন্য ২০১২ সালে সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ২০ বছর মেয়াদি (২০১২-৩২ সাল) একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করে। এতে বলা হয়েছে, ক্রমান্বয়ে ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে ২০৩২ সালে ৩২ শতাংশ করা হবে। বাকিটা সরকার বহন করবে। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, ব্যয় তত বাড়ছে। সর্বশেষ ২০২০ সালে এ ব্যয় বেড়ে প্রায় ৬৯ শতাংশ হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনেক পিছিয়ে পড়ছে। পাশাপাশি চিকিৎসা খরচ বহনে আর্থিক বিপর্যয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ।

এমন প্রেক্ষাপটে ‘কারও স্বাস্থ্যকেই পেছনে না রেখে সবার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ করুন’ প্রতিপাদ্য নিয়ে সারা বিশ্বের মতো আজ দেশেও পালিত হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস-২০২১।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেন, গবেষণায় দেখা যায়, দেশে ১৯৯৭ সাল থেকে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারের ভাগ ক্রমান্বয়ে ছোট হচ্ছে। এতে হিমশিম খাচ্ছে রোগীর পরিবার। ২০১২ সালে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট কৌশলপত্র তৈরির সময় ব্যক্তির আউট পকেট এক্সপেনডিচার অর্থাৎ নিজস্ব ব্যয় ছিল ৬৪ শতাংশ। ২০১৫ সালে ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে ৬৭ শতাংশ হয়। ২০১৭ সালে ছিল ৬৭ শতাংশ। ২০২০ সালে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের সর্বশেষ গবেষণায় দেখা গেছে ব্যক্তির স্বাস্থ্য খাতের মোট ব্যয় বেড়ে ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে। ২০১৭ সালের স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ব্যক্তির স্বাস্থ্য ব্যয় মালদ্বীপে ১৮, ভুটানে ২৫, শ্রীলংকায় ৪২, নেপালে ৪৭, পাকিস্তানে ৫৬ আর ভারতে ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি।

বর্তমানে দেশের সরকারি হাসপাতালে মাত্র ৩ শতাংশ রোগী ওষুধ ও ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ রোগী পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ পেয়ে থাকেন। ফলে অধিকাংশ রোগীকে ফার্মেসি থেকে ওষুধ ক্রয় এবং ডায়াগনস্টিক থেকে সেবাগ্রহণ করতে হয়। এ কারণে স্বাস্থ্যের ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশে প্রতিবছর প্রায় ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। এতে রোগীরা প্রায়ই আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেন, ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ বাংলাদেশে অনেকে বেশি। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার ভুটান, শ্রীলংকা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। এমনকি ভারত, পাকিস্তানের চেয়েও আমরা পিছিয়ে। ব্যক্তির আউট পকেট এক্সপেনডিচারে বাংলাদেশ বিশ্বে পেছনের সারিতে। গবেষকরা জানান, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে তিনটি ডাইমেনশন বা দিক রয়েছে। প্রথমটি, প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়া। দ্বিতীয়টি, প্রয়োজন অনুযায়ী রোগীদের মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। সর্বশেষটি হলো-স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের কারণে সৃষ্ট আর্থিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা। কিন্তু তৃতীয় ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন থেকে বাংলাদেশ বহুদূর পিছিয়ে রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, একজন ব্যক্তি বছরে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে ১০০ টাকা খরচ করলে তার মধ্য থেকে ৬৪ টাকা চলে যায় ওষুধ কিনতে। অর্থাৎ ব্যক্তির সিংহভাগ টাকা চলে যায় ওষুধের পেছনে। এর কারণ, দেশের ৮৬ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নেয় বেসরকারি খাত থেকে। বাকি ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ মানুষ সরকারি হাসপাতালে যায়। এ কারণে চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে প্রতিবছর ৮৬ লাখের বেশি মানুষের আর্থিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। ব্যয় বেশি হওয়ায় ১৬ শতাংশ খানা স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া থেকে বিরত থাকছে। অর্থাৎ তিন কোটির বেশি মানুষ প্রয়োজন হলেও চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে যাচ্ছেন না। মূলত সরকারিতে মানসম্মত সেবার নিশ্চয়তা না মেলায় বেসরকারিতে ঝুঁকছে। এতে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রায় সব দেশের রোগীদেরই হিমশিম খেতে হয়। আমাদের সমস্যা হলো-চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ রোগীর কাছে ঠিকমতো পৌঁছায় না। সরকারি হাসপাতালে ওষুধ চুরি বন্ধে মোড়কে লাল-সবুজ রং জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে কেউ বাইরে ওষুধ বিক্রি করতে না পারে। আরেকটি বিষয় হলো, রোগীর চাহিদা অনুযায়ী অনেক হাসপাতালে ওষুধ-পথ্যের পর্যাপ্ততা থাকে না। যেমন, আইসিইউ বা জেনারেল সার্জারিতে তাৎক্ষণিকভাবে ওষুধের প্রয়োজন হলে অনেক হাসপাতালে সরবরাহ নেই। স্বজনদের বাধ্য হয়ে দ্বিগুণ দামে বাইরে থেকে কিনতে হয়। এসব কারণে পকেট খরচ বাড়ছে। এজন্য স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো, ওষুধের প্রাপ্যতা ও চিকিৎসার মান নিশ্চিত করতে হবে। গরিব রোগীদের সব ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে দিতে হবে। হাসপাতাল ও রোগী ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ও অস্ত্রোপচারের মতো চিকিৎসা ব্যয় রোগীদের নাগালে রাখতে হবে। না হলে চিকিৎসা ব্যয় কমানোর লক্ষ্য অর্জন পিছিয়ে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিউটের অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে ব্যক্তিকে তার প্রয়োজনের সময় মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে মানুষ যেন সেবা নেওয়া থেকে বিরত না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন হচ্ছে না। এটা অর্জনে স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, অর্থ, পরিকল্পনা ও স্থানীয় সরকারের মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দপ্তরগুলোকে একটি সেল বা কমিটি তৈরি করে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বা ২০৪১ সালের রূপকল্প বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

স্বাস্থ্য অধিপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম দাবি করেন, ব্যক্তির আউট পকেট এক্সপেনডিচার কমানোর জন্য সরকার বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। ইতোমধ্যে পরিকল্পনা বিভাগ, সংক্রামক ও অসংক্রমাক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ এবং হাসপাতাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট যৌথভাবে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ব্যক্তির চিকিৎসা খরচ কীভাবে কমানো যায়, সেটি নিয়ে কাজ হচ্ছে। হাসপাতালে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে। সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা, হাসপাতাল সেবায় অটোমেশন পদ্ধতি চালু এবং সেগুলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চতকরণে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। এভাবে রোগীদের পকেট ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে চেষ্টা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান। সূত্রঃ যুগান্তর

Share this post

scroll to top