নিজের ছয় বছরের কন্যাসন্তানকে হত্যা করে পাতিলের মধ্যে ভরে রেখেছে পাষণ্ড বাবা। শুনলেই গা শিউরে ওঠে। কিভাবে সম্ভব হলো একজন বাবার পক্ষে! পুলিশ বলেছে, মায়ের পরকীয়ার কারণে বাবা এই কাজ করেছেন। এ দিকে, মামীর সাথে ভাগ্নের পরকীয়া দেখে ফেলায় খুন হতে হয়েছে নানাকে।
দুই পুলিশ মিলে ইয়াবা খাইয়ে ধর্ষণ করেছে এক তরুণীকে। এর একদিন আগেই শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয়েছে ইডেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষকে। এভাবে একের পর এক নৃশংস ঘটনায় দিশেহারা মানুষ। মানুষের মধ্যে এসব নিয়ে বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আসলে ভিনদেশীয় কালচার ঢুকে যাওয়ায় মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ে এভাবে একের পর ঘটনা ঘটেই চলছে।
গাজীপুর জেলার শ্রীপুর পৌর এলাকার গিলারচালা গ্রামে এক পাষণ্ড বাবা তার ৬ বছর বয়সী কন্যাসন্তানকে হত্যা করে লাশ পাতিলের ভেতরে ভরে রেখে পালিয়েছে। ১০ ফেব্রুয়ারি খাটের নিচ থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। মনিরা খাতুন নামে ওই শিশুর বাবার নাম রফিকুল ইসলাম।
পুলিশ বলেছে, মেয়েটির মা নাসরিন পরকীয়ায় আসক্ত ছিলেন। এ নিয়ে দ্বন্দ্বে স্বামী-স্ত্রী ভিন্ন হয়ে যান। সন্তানের কথা চিন্তা করে আবারো তারা একত্রে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু নাসরিন পরকীয়া ছাড়তে পারেননি। যে কারণে রফিকুল তার মেয়েকে হত্যা করে এভাবে পথের কাঁটা দূর করে পালিয়েছে বলে সবার ধারণা। শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাবেদুল ইসলাম জানান, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে কলহ চলছিল। ঘটনার পর থেকে শিশুটির বাবা রফিকুল ইসলাম পলাতক রয়েছে।
অপর এক পরকীয়ার বলি হলেন কুষ্টিয়ার খোকসার মজিবুর রহমান (৭৫)। পুত্রবধূর অশ্লীল কর্মকাণ্ড দেখে ফেলেছিলেন তিনি। পুলিশ অভিযুক্ত নাতি ছেলে নাঈম (২১) ও নিহতের পুত্রবধূ সামিয়াকে (৩৪) আটক করেছে।
খোকসা থানার ওসি এ বি এম মেহেদী মাসুদ জানান, বেশ কিছুদিন ধরেই নিহত মজিবুর রহমানের বড় মেয়ের বড় ছেলে নাঈমের সাথে মেজো ছেলের স্ত্রী সামিয়ার অবৈধ পরকীয়ার সম্পর্ক চলছিল। রোববার রাতে ঢাকা থেকে এসে নাঈম নানা বাড়ি যায়। মেজো মামা মাসুদের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী সামিয়ার সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত হয় ভাগনে নাঈম। এ সময় নানা মজিবুর রহমান দেখে ফেলেন। বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে নাঈম তার নানাকে ঘর থেকে বারান্দায় বের করে এনে বুকে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে মজিবুর রহমানকে উদ্ধার করে খোকসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় পাওনা টাকা চাইতে গেলে দুই পুলিশ কর্মকর্তা মিলে এক তরুণীকে দু’রাত আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে। দুই পুলিশ কর্মকর্তা অস্ত্রের মুখে ওই তরুণীকে ইয়াবা সেবনে বাধ্য করে। পরে তাকে ধর্ষণ করা হয়। এসআই সেকেন্দার ও এএসআই মাজাহারুল ইসলাম নামে ওই দুই পুলিশ সদস্যকে ক্লোজড করা হয়েছে।
রাজধানীতে দেবরের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন ভাবী শারমীন আক্তার (৩৫)। এ সময় ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয়েছেন মা হামিদা বেগম। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে টঙ্গী সদর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার বিকেলের দিকে দক্ষিণখান থানাধীন ফায়দাবাদ এলাকার একটি কলোনিতে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ ঘটনার পর নিহত শারমীন আক্তারের দেবর শফিকুলকে আটক করেছে বলে জানা গেছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রতিবেশী তরিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ফায়দাবাদ টিআইসি কলোনির ৯৭ নম্বর বিল্ডিংযে স্বামী মো: বিপ্লবের সাথে বসবাস করছিলেন স্ত্রী শারমীন। একই সাথে বিপ্লবের মা ভাইবোন ও পরিবারের অন্য সদস্যরা বসবাস করেন। বিকেল ৫টায় ছোট ছেলে শফিকুলের সাথে তার মা হামিদা বেগমের কথা কাটাকাটি হয়। এ সময় উত্তেজিত হয়ে শফিকুল তার মাকেই ছুরিকাঘাত করতে ছোরা হাতে তেড়ে যায়। তখন ভাবী শারমীন আক্তার বাধা দিতে গেলে একপর্যায়ে শফিকুল তাকেও এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করতে থাকে। ভাবী শারমীনের পেটে ও বুকে এবং মা হামিদা বেগমের হাতে আঘাত লাগে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে টঙ্গী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার ভাবী শারমীনকে মৃত ঘোষণা করেন। মা চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে জানান তিনি।
প্রতিবেশী তরিকুল ইসলাম আরো জানান, শফিকুল বিদেশ গিয়ে ও ব্যবসাবাণিজ্য করে ধরা খেয়েছেন। এরপর থেকেই সে ভরঘুরে হিসেবে চলাফেরা করছে। প্রায়ই সে তার মার কাছ থেকে টাকা চায়। এ নিয়ে মা-ছেলের মধ্যে প্রায় ঝগড়া হয়। এর জের ধরে ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণা তার।
গত রাতে দক্ষিণখান থানার ওসি তপন কুমার সাহা খুনের ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে শফিকুলকে আটক করেছেন বলে সাংবাদিকদের জানান।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা সোহেল বলেছেন, এসবই ঘটছে ভিনদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন ও নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে।
মোস্তফা সোহেল বলেন, পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে গবেষণা রয়েছে। সেই গবেষণায় দেখা গেছে, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, নষ্ট সংস্কৃতি, প্রযুক্তির অপব্যবহার মানুষকে বিপথগামী করছে। বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেলগুলো দেখে মানুষ উচ্ছন্নে যাচ্ছে। খারাপ কাজে মানুষ উৎসাহ পাচ্ছে। এ থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে আমরা শেষ হয়ে যাবো। তিনি বলেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কটে থাকলে, আইনের শাসন না থাকলে, প্রলম্বিত বিচার ব্যবস্থা থাকলে এরূপ ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী মানবাধিকারকর্মী সাইদুর রহমান বলেন, আগে মূল্যবোধের চর্চা হতো। এখন পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কোথাও মূল্যবোধের চর্চা নেই। মূল্যবোধ সৃষ্টি শক্তি প্রয়োগ করে সম্ভব নয়। সেটা চর্চার দরকার। আর সেটা সম্ভব হলেই এই নৃশংসতা কমবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান এ নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন। এক বিদেশী মিডিয়াকে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সহিংসতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন একটা সময় পার করছি যখন কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে শিল্পভিত্তিক সমাজে যাচ্ছি। তাই নারী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে পরিবর্তন আসছে। পুরুষের আগে থেকেই সুযোগ ছিল। নারীরও এখন সুযোগ হয়েছে। প্রযুক্তি মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সম্পর্কের ধারণা পরিবর্তন করছে। সম্পর্কের নানা দিক দেখিয়ে দিচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে আচরণে। পারিবারিক কলহ বাড়ছে। আর বাড়ছে পারিবারিক কলহ ও দ্বন্দ্বের কারণে হত্যা। বিশ্বায়নেরও প্রভাব আছে। আর সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব তো নতুন কিছু নয়। তবে এসব কারণে হত্যাকাণ্ড এখন বাড়ছে। বাড়ছে নৃশংসতা। আমরা পরিবর্তনের সাথে মূল্যবোধ ও মানবিকতাকে সমানভাবে ধরে রাখতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘আর এর ফলে সমাজে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হচ্ছে। নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীন এখন। কিন্তু সমাজকে টিকিয়ে রাখতে হলে, রাষ্ট্রকে সুশৃঙ্খল রাখতে হলে, বাসযোগ্য করতে হলে, আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে শক্ত করতে হবে। এর চর্চা করতে হবে। শুধু আইন দিয়ে সব কিছু হবে না।