সন্তানের পড়ার খরচ নিয়ে বিড়ম্বনায় সীমিত আয়ের লোকজন

প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের শহর রাজধানী ঢাকা। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর জন্য রয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি সরকারি স্কুল ও কলেজ। ফলে প্রাইমারি থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এমনকি উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা মূলত পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি খাতে। আর এ কারণে রাজধানীবাসীর সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য গুনতে হচ্ছে বিপুল অর্থ। স্বল্প আয়ের লোকজন তো বটেই মধ্যম আয়ের অনেক লোকজনও তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। বিশেষ করে যাদের একাধিক সন্তান লেখাপড়ার সাথে যুক্ত তাদের অবস্থা শোচনীয়। বাড়িভাড়ার পাশাপাশি তাদের আয়ের একটি বিশেষ অংশ চলে যাচ্ছে সন্তানদের লেখাপড়ার পেছনে। ফলে সংসারের অনেক প্রয়োজনীয় এবং জরুরি খাতেও তারা অর্থ ব্যয় করতে পারছেন না।

সন্তানদের শিক্ষায় ব্যয় করা বর্তমানে অনেকেই সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করছেন। স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন, পরবর্তীতে নামকরা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চান্স পাওয়া, ভালো ক্যারিয়ারের অধিকারী হওয়ার সাথে এখন নিবিড়ভাবে জড়িত সন্তানের লেখাপড়ার পেছনে কে কতটা অর্থ ব্যয় করতে পারছে তার ওপর। বিশেষ করে রাজধানীতে এ বাস্তবতার অনেক নজির রয়েছে। সে কারণে শিক্ষায় ব্যয় করা নিয়ে অনেকের মধ্যে চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা। যাদের অর্থের অভাব নেই তারা সন্তানের লেখাপড়ার জন্য দু’হাতে টাকা খরচ করছেন।

প্রতি বিষয়ে কোচিং প্রাইভেটসহ নানা খাতে অঢেল টাকা খরচ করতে তারা কার্পণ্য করছেন না। বাংলা মাধ্যমে এসএসসি পড়ুয়া এক সন্তানের কোচিং প্রাইভেটের পেছনে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা খরচ করছেন এমন অভিভাবকেরও অভাব নেই রাজধানীতে। বাংলা এবং ধর্ম বিষয়েও তারা কোচিং করান। এমনকি অনেকে একই বিষয়ে একাধিক কোচিংয়ে পড়াচ্ছেন, একাধিক প্রাইভেট টিউটর রাখছেন এমন নজিরও রয়েছে। তাদের সন্তানদের অনেকে পরীক্ষায়ও ভালো ফলাফল করছে এভাবে সারা বছর কোচিং প্রাইভেটের সাথে যুক্ত থাকার কারণে।

এসএসসি এইচএসসি পাসের পর নামকরা ভালো ভালো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চান্স পাচ্ছে তারা। ভবিষ্যতে ভালো ক্যারিয়ারেরও অধিকারী হচ্ছে। কিন্তু যাদের আয় সীমিত তারা এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছেন প্রতিযোগিতায়। পর্যাপ্ত অর্থ ব্যয়ের কারণে রাজধানীতে স্বল্প এবং মধ্যম আয়ের অনেক পরিবারের সন্তানেরা কাক্সিক্ষত ফলাফল যেমন করতে পারছে না তেমনি পরে পিছিয়ে পড়ছে নানা ক্ষেত্রে। এ নিয়ে চলছে নানা ধরনের পারিবারিক সামাজিক দ্বন্দ্ব আর হতাশা।

পঞ্চাষোর্ধ্ব আউয়াল বাস করেন রাজধানীর বনশ্রীতে দুই রুমের একটি ভাড়া বাসায়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আউয়াল তিন সন্তানের জনক। তার প্রথম সন্তান সপ্তম শ্রেণীতে, দ্বিতীয়জন চতুর্থ শ্রেণীতে এবং তৃতীয় সন্তান প্রথম শ্রেণীতে। আউয়াল জানান, নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে কাটাতে হয় তাদের। নভেম্বর মাসেই তিন সন্তানের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেতন, পরীক্ষার ফি এক সাথে দিতে হয়।

গত বছর ১২ হাজার টাকার মতো লেগেছে এ বাবদ। এরপর ডিসেম্বর মাসের শেষেই আবার তিনজনেইর ভর্তি বা সেশনচার্জ দিতে হয়। প্রত্যেকের সেশনচার্জ সাড়ে সাত হাজার টাকা করে। এর সাথে জানুয়ারি মাসের বেতন দেড় হাজার টাকা করে। সেশনচার্জ এবং জানুয়ারি মাসের বেতন বাবদ গত ডিসেম্বরে তিন সন্তানের জন্য স্কুলে একবারে দিতে হয়েছে ২৭ হাজার টাকা।

এরপর জানুয়ারি মাসে প্রতি সন্তানের জন্য স্কুল থেকে দেয়া খাতার জন্য প্রায় আড়াই হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। এ ছাড়া তিন সন্তানের জন্য নতুন স্কুল ড্রেস, জুতা ব্যাগসহ আরো কিছু বিষয় মিলিয়ে ৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এভাবে গত কয়েক বছর ধরে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি এই তিন মাসে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। আর সারা বছর প্রতি মাসে স্কুলের বেতন রয়েছে সাড়ে চার হাজার টাকা। এ ছাড়া রয়েছে বছরজুড়ে খাতা, কলম, পেন্সিল, রং পেন্সিলসহ নানা ধরনের জিনিস কেনাকাটা, টিফিন, রিকশা ভাড়ার খরচ।

আউয়াল বলেন, আমার মাসিক আয় নির্ধারিত এবং তা খুব বেশি নয়। মাস শেষে আমার কাছে কোনো টাকা অতিরিক্ত থাকে না। বরং যে বেতন পাই তা দিয়ে অনেক সময় সংসারের প্রয়োজনীয় অনেক জিনিস কেনা থেকে বিরত থাকতে হয়। ফলে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে ৫০ হাজার টাকা জোগাড় করা আমার জন্য খুবই কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আত্মীয়স্বজনের কাছে অনেক সময় ধার দেনা করতে হয়।

আউয়াল জানান, প্রতি বছর বাড়িভাড়া, সন্তানের লেখাপড়াসহ বিভিন্ন কারণে পরিবারের খরচ শুধু বেড়েই চলছে। কিন্তু সে অনুযায়ী আয় বাড়ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে চলতি বছর তিনি আগের চেয়ে ছোট বাসা ভাড়া নিয়েছেন।

আউয়াল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পুরো বনশ্রী এবং তার আশপাশে কোথাও কোনো সরকারি স্কুল-কলেজ নেই। সরকারি প্রাইমারি স্কুল বা হাইস্কুল থাকলে সন্তানদের লেখাপড়া বাবদ অনেক খরচ সাশ্রয় হতো।

রাজধানীর সিপাহীবাগে ভাড়া বাসায় বসবাসকারী খায়রুল ইসলাম বলেন, তার দুই সন্তান। একজন অষ্টম শ্রেণীতে আরেকজন ষষ্ঠ শ্রেণীতে। দুইজনই বেসরকারি স্কুলে পড়ে। তার কোনো সন্তানের জন্য কোচিং প্রাইভেটের ব্যবস্থা নেই। কারণ তার যে আয় তা দিয়ে এটা সম্ভব নয়।

খায়রুল জানান, তার মেয়ে সমাপনী পরীক্ষায় গড়ে ৮৯ শতাংশ নম্বর পেয়েছে। কিন্তু তার বিশ্বাস তিনি যদি কোনো কোচিং প্রাইভেটে দিতে পারতেন তাহলে আরো বেশি নম্বর পাওয়া সম্ভব ছিল। তার পরিচিত অনেকে তাদের পঞ্চম শ্রেণীপড়ুয়া সন্তানদের সারা বছর কোচিং করিয়েছে এবং অনেকে ৯৬ থেকে ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত নম্বর পেয়েছে। তারা বৃত্তিও পাবে হয়তো। তাদের টাকা ছিল এবং তা সন্তানের পড়ালেখার পেছনে খরচ করেছে। এখন তার সুফল হিসেবে বৃত্তি পাবে। খায়রুল তাই আফসোস করে বলেন, কিন্তু আমরা খরচ করতে পারিনি। আমাদের বৃত্তি পাওয়ারও আশা নেই। তাই তাদের সাথে আমরা প্রতিযোগিতায় পারছি না। এভাবে আমরা পিছিয়ে পড়ছি।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top