দল গোছাটনোর জন্য যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করতে যাচ্ছে বিএনপি

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপিতে পুনর্গঠনের সুর বাজছে। দাবি উঠেছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সংগঠন ঢেলে সাজানোর। আর এ দাবি আমলে নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির পাশাপাশি সারা দেশে দলের সাংগঠনিক অবস্থার খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে হাইকমান্ড। প্রাথমিক পর্যালোচনায় অঙ্গসংগঠনসহ দলটির ভঙ্গুর সাংগঠনিক অবস্থার চিত্রই ফুটে উঠেছে।
দলটির সিনিয়র অনেক নেতা মনে করেন, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর দল গোছানোর যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল নানা কারণে তা সম্পূর্ণ করা যায়নি। অর্ধেকেরও বেশি সাংগঠনিক জেলায় কমিটি দেয়া হলেও তা ত্রুটিমুক্ত ছিল না। ১১টি অঙ্গসংগঠনের অবস্থাও বেহাল। ৪-৫টি সংগঠনের আংশিক নতুন কমিটি হয়েছে, কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার উপক্রম হলেও এসব কমিটির কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ হয়নি। এর প্রভাব একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিতেও পড়েছে বলে নেতারা বলেছেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর যে নতুন কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয় সেই কমিটিতেও বহু পদ ফাঁকা ছিল, যা গত তিন বছরেও পূরণ করা হয়নি। এমনকি দলের সর্বোচ্চ ফোরাম স্থায়ী কমিটিতেও কমপক্ষে তিনটি পদ ফাঁকা ছিল শুরু থেকেই। এখন তা ৫টিতে দাঁড়িয়েছে। দলটির অর্ধেকেরও বেশি সাংগঠনিক জেলায় নতুন কমিটি দেয়া হয়েছিল, কিন্তু ঘুরে ফিরে একই নেতা শীর্ষ পদগুলো আঁকড়ে থাকায় নেতৃত্বে গতিশীলতা আসেনি। উপজেলা-থানা-ইউনিয়ন কমিটি থাকলেও এসব কমিটির কয়েকটি পদধারী ছাড়া সবাই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে। মামলা-হামলা-জেল এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কারণ হলেও তৃণমূল নেতাদের মনোবল অটুট রাখতে কেন্দ্র যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

পূর্ণাঙ্গ হয়নি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তর বিএনপির কমিটি : ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সভাপতি ও কাজী আবুল বাশারকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ৭০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। একইভাবে এম এ কাইয়ুমকে সভাপতি ও আহসান উল্লাহ হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ৬৬ সদস্যের আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ঘোষণার সময় বিএনপির হাইকমান্ড থেকে বলা হয়েছিল, এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হবে; কিন্তু দেখতে দেখতে দুই বছর চলে গেলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি উত্তর ও দক্ষিণের নেতারা। অবশ্য তারা এক বছরের মাথায় থানা ও ওয়ার্ড কমিটি ঘোষণা দিয়েছে। কমিটি গঠনের পর পুরনো কোন্দল বেড়েছে। ত্যাগী নেতাকর্মীদের একটি অংশকে পদ দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। এ নিয়েও পদবঞ্চিতদের বড় একটি অংশই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে ঢাকা মহানগর বিএনপি নেতাকর্মীদের ভূমিকাও দৃশ্যমান ছিল না।

মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রদল : ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর রাজিব আহসানকে সভাপতি ও আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের ১৫৩ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। পরে তা পূর্ণাঙ্গ করে ৭৩৬ সদস্যের ঢাউস কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই সময় ছাত্রদল সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র সহসভাপতিকে বিএনপির নির্বাহী কমিটিতেও ঠাঁই দেয়া হয়। ছাত্রদলের শীর্ষ অবস্থানে থাকাবস্থায় ওই তিন নেতা বিএনপির নির্বাহী কমিটিতে ঠাঁই পাওয়ায় তারা এমপি প্রার্থী হওয়ার জন্য তোড়জোড় করেন। বিএনপি অবশ্য তাদের মনোনয়ন দেয়নি। এখন সংগঠনটির কমিটি আড়াই বছর আগে মেয়াদোত্তীর্ণ। কমিটি হালনাগাদ না থাকায় আসন্ন ডাকসু নির্বাচনে প্যানেল দিতে সংগঠনটিকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। জানা গেছে, ছাত্রদলের এই বেহাল অবস্থায় ডাকসু নির্বাচনের পর নতুন কমিটি দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে বিএনপির হাইকমান্ড।

পূর্ণাঙ্গ হয়নি যুবদল কমিটি : দুই বছর ধরে আংশিক কমিটিতেই আটকে রয়েছে বিএনপির অন্যতম অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদল। পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার প্রক্রিয়াই শুরু করতে পারেননি দায়িত্বশীল নেতারা। নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, হচ্ছে হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়। কিন্তু এক মাসের মধ্যে কমিটি গঠনের বাধ্যবাধকতা পেরিয়ে দুই বছরেও হয়ে ওঠেনি পূর্ণাঙ্গ কমিটি। ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি যুবদলের কেন্দ্রীয়, ঢাকা মহানগর উত্তর ও মহানগর দক্ষিণের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে কেন্দ্রীয় যুবদলের সভাপতি সাইফুল আলম নীরব ও সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু। মহানগর উত্তর যুবদল সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর ও দক্ষিণের সভাপতি রফিকুল ইসলাম মজনু। এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার নির্দেশ থাকলেও তা হয়নি। এ নিয়ে তৃণমূল নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু জেলে রয়েছেন। সভাপতি সাইফুল আলম নীরব মামলা-হুলিয়া নিয়ে নিরাপদ অবস্থানে রয়েছেন। সদ্যসমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-১০ আসনে বিএনপির প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু এক দিনের জন্যও প্রচারণায় মাঠে নামতে পারেননি তিনি। তবে তিনি বলছেন, তার বিরুদ্ধে দুই শতাধিক মামলা রয়েছে। গ্রেফতার এড়াতে কৌশলে তাকে প্রচারণা চালাতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করতে না পারলেও বহু জেলায় নতুন কমিটি দেয়া হয়েছে।

৭ নেতা দিয়ে আড়াই বছর পার স্বেচ্ছাসেবক দলের : ২০১৬ সালের ২৮ অক্টোবর জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত কমিটিতে শফিউল বারী বাবুকে সভাপতি ও আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এ ছাড়া সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান, সহসভাপতি গোলাম সারোয়ার, সাইফুল ইসলাম ফিরোজ ও সাদরাজ্জামানকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ইয়াসিন আলীকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। কমিটিকে এক মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় অনুমোদনের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয় বিএনপির হাইকমান্ড থেকে; কিন্তু আড়াই বছরের বেশি সময়েও পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি স্বেচ্ছাসেবক দল। অবশ্য তারা জেলা পর্যায়ে কমিটি ঘোষণা করেছে।

৩ বছর ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ শ্রমিক দল : বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল ২০১৪ সালের ১৯ ও ২০ এপ্রিল দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের তিন দিন পর আনোয়ার হোসেনকে সভাপতি, নুরুল ইসলাম খান নাসিমকে সাধারণ সম্পাদক ও জাকির হোসেনকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ৩৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করে। প্রায় তিন বছর আগে শ্রমিক দলের কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গ্রুপিং ও কোন্দল বেড়েছে। দলের কার্যক্রম নেই বললেই চলে।

২০ বছর আগের কমিটি দিয়ে চলছে কৃষক দল : ১৯৯৮ সালের ১৬ মে কাউন্সিলের মাধ্যমে কৃষক দলের কমিটি গঠন হয়। ২০ বছর আগের সেই কমিটি দিয়েই চলছে গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গসংঠনটি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৯ বছর কৃষক দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলের পর তিনি মহাসচিব হলে কৃষক দল ছেড়ে দেন। টানা ২৮ বছর ধরে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন শামসুজ্জামান দুদু। তিনি এখন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান। মাঠপর্যায়ে কৃষক দলের অবস্থাও বেহাল। সংগঠনের নেতাকর্মীরা বলছেন, কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি জরুরি। নইলে এই সংগঠনটির বিপর্যয় কাটছে না।

মহিলা দল : জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের বর্তমান সভাপতি আফরোজা আব্বাস ও সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ। এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেনি বর্তমান নেতৃত্ব। তবে মহিলা দল সাফল্য দেখিয়েছে জেলা পর্যায়ে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠনে। ২৯ জেলায় মহিলা দল সম্মেলন করেছে। ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের থানা পর্যায়ের কমিটিও গঠন করা হয়েছে সম্মেলনের মাধ্যমে।
জাসাস : বর্তমান কমিটির সভাপতি ড. অধ্যাপক মামুন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক চিত্রনায়ক হেলাল খান। এই কমিটি গঠনের পর বিক্ষোভ শুরু হয়। বিএনপির আন্দোলনে অঙ্গসংগঠন জাসাস এক সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকত। সেই জাসাস এখন একেবারেই নীরব। নেতাকর্মীদের মধ্যে মতবিরোধ ও গ্রুপিং চলছে বলে জানা গেছে।

মুক্তিযোদ্ধা দল : গ্রুপিং ও কোন্দলে অকেজো হয়ে পড়েছে মুক্তিযোদ্ধা দল। এ সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়ে নানামুখী মেরুকরণ চলছে। একটি অংশ দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাৎকে মেনে চলছে। অন্য অংশ দলের সাধারণ সম্পাদক সাদেক আহমেদ খানের অনুসারী। এই কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে।।

ওলামা দল : জাতীয়তাবাদী ওলামা দলও মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে। দীর্ঘদিন ধরে ওলামা দলের সভাপতি মাওলানা আবদুল মালেক ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা শাহ মো: নেছারুল হক। পদ-পদবি নিয়ে এই সংগঠনেও গ্রুপিং-লবিং চলছে। নতুন কমিটি গঠনের দাবি তৃণমূল নেতাকর্মীদের।

তাঁতী দল : ২০০৮ সালের ২২ মে তাঁতী দলের কমিটি গঠন করা হয়। এরপর আর কাউন্সিল হয়নি। এই কমিটির অবস্থাও বেহাল। বর্তমান সভাপতি হুমায়ুন ইসলাম খান পরপর দুইবার সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁতী দল পুনর্গঠনের দাবি তৃণমূল নেতাকর্মীদের।

মৎস্যজীবী দল : ২০১১ সালের ২ ডিসেম্বর জাতীয়তাবাদী মৎস্যজীবী দলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। তিন সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটির সভাপতি হন রফিকুল ইসলাম মাহতাব, সাধারণ সম্পাদক সাবেক ছাত্রনেতা মিলন মেহেদী ও সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল আউয়াল। ৮ বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়নি। সভাপতি ও সম্পাদকের মধ্যে এবং সমন্বয় নেই বলে জানা গেছে।
অঙ্গসংগঠনগুলোর এমন বেহাল অবস্থা উত্তরণে পর্যায়ক্রমে নতুন নেতৃত্বে কমিটি গঠনের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামীতে ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত করতে চায় বিএনপির হাইকমান্ড। এই মুহূর্তে কাউন্সিল করা সম্ভব না হলেও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির শূন্যপদগুলো পূরণ করা হতে পারে বলে কেউ কেউ জানিয়েছেন।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে যেসব দুর্বলতা আছে তা অতি দ্রুত সংশোধন করা হবে। সংগঠন শক্তিশালী ও কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top