নগদে লভ্যাংশ দিয়ে মূলধন হারাচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। যথাযথভাবে খেলাপি ঋণও নবায়ন হচ্ছে না। এতে বাড়ছে মুনাফা। আবার কোনো কোনো ঋণ আদায় না করেই আদায় দেখানো হচ্ছে। এতেও বাড়ছে মুনাফা। নানা কারসাজির মাধ্যমে প্রতি বছরই কিছু কিছু ব্যাংক মুনাফাকে স্ফীত করছে। আর এ মুনাফার ওপর ভর করেই নগদে লভ্যাংশ দেয়া হচ্ছে।
বাজার বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে নগদে লভ্যাংশ দেয়ার অনুমোদন কোনো ক্রমেই ঠিক হবে না। কারণ, ব্যাংকগুলো সঠিক উপায়ে খেলাপি ঋণ নবায়ন করছে না। এর ফলে যথাযথভাবে প্রভিশন সংরক্ষণ করছে না। এতে বাড়ছে মুনাফা। এ মুনাফার ওপর ভর করে নগদে মুনাফা দেয়ার অনুমোদন দেয়ার অর্থ সাধারণ আমানতকারীদের অর্থ কারো পকেটে চলে যাওয়া। এটা বন্ধ না করতে পারলে সামনে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়াই ব্যাংকের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়বে। এতে আস্থার সঙ্কট দেখা দেবে ব্যাংকিং খাতে, যা ব্যাংকিং খাতকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেবে। এ পরিস্থিতিতে বোনাস শেয়ার দেয়ার অনুমোদন দেয়া যেতে পারে। কিন্তু কোনোক্রমেই নগদ মুনাফা দেয়ার অনুমোদন দেয়া ঠিক হবে না।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো নানা উপায়ে হিসাবের কারসাজি করে থাকে। যেমন, খেলাপি ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ ব্যাংকগুলো আয় খাতে নিতে পারে না। এটি আলাদা হিসাবে রাখতে হয়। খেলাপি ঋণ আদায় হলে এর বিপরীতে আয় মুনাফা হিসাবে দেখাতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ ব্যাংকই বার্ষিক মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য খেলাপি ঋণের বিপরীতে স্থগিত আয় মুনাফা হিসাবে দেখায়। অপর দিকে, মেয়াদি আমানতের বিপরীতে বার্ষিক সুদ বা মুনাফার অংশ ‘পেয়েবল’ হিসেবে প্রভিশন করতে হয়। কোনো কোনো ব্যাংক ওই পেয়েবল হিসাবে রাখা টাকাকে আয় খাতে প্রদর্শন করছে। এ ছাড়া ঋণের বিপরীতে সম্ভাব্য আয় নির্ধারণে ‘রিসিভেবল’ হিসাবে টাকা রাখা হয়। ভবিষ্যতে আয় হতে পারে এমন একটি অঙ্ক রিসিভেবল আয় হিসাবে গণ্য হয়। কিন্তু ওই অঙ্কেই আয় প্রকৃতপক্ষে না হলেও তা আয় হিসেবে প্রদর্শন করছে ব্যাংকগুলো। এতেও বাড়ছে মুনাফা। এভাবে মুনাফা বাড়াতে নানা কারসাজির আশ্রয় নিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে খেলাপি ঋণ ও মুনাফার হিসাবে তদারকি করতে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব গরমিল বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে গোপন করা আয় ও খেলাপি ঋণের একটি অংশ বের হয়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ ও আয় সমন্বয় করতে গিয়ে কমে যাচ্ছে ব্যাংকের প্রকৃত আয়। ফলে সব মিলে বছর শেষে ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ পরিচালন মুনাফা দেখাচ্ছে প্রকৃত মুনাফা তার চার ভাগের এক ভাগে নেমে যাচ্ছে। আর এ ভাবেই প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ গ্রাহক। বিষয়টিকে ভালোভাবে নজরে নিয়ে ব্যাংকের মুনাফার জালিয়াতি বন্ধ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ব্যাংক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, মুনাফার জালিয়াতি ঠেকাতে না পারলে ডিভিডেন্ডের মাধ্যমে ব্যাংকের মূলধন ক্ষয় হয়ে যাবে। আর এর প্রভাব শুধু ব্যাংকিং খাতেই নয়, পুরো অর্থনীতিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে কিছু ব্যাংক বোনাস শেয়ারের পরিবর্তে নগদ লভ্যাংশ দেয়ার প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছে। ২০১৭ সালে ১০টি ব্যাংক শুধু নগদে লভ্যাংশ দিয়েছে। এর আগের বছরে ১৪টি ব্যাংক নগদে লভ্যাংশ দিয়েছে। ২০১৭ সালে নগদে লভ্যাংশ দেয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে, ডাচ বাংলা ৩০ শতাংশ, ইস্টার্ন ব্যাংক ২০ শতাংশ, এক্সিম ব্যাংক সাড়ে ১২ শতাংশ, ইসলামী ব্যাংক ১০ শতাংশ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ১৭ শতাংশ, এনসিসি ব্যাংক ১৩ শতাংশ, ট্রাস্ট ব্যাংক ২০ শতাংশ, ইউসিবিএল ১০ শতাংশ ও উত্তরা ব্যাংক ২০ শতাংশ নগদে লভ্যাংশ দিয়েছে। আর ক্যাশ ও বোনাস শেয়ার দিয়েছে ৫টি ব্যাংক। এর মধ্যে আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়ার পাশাপাশি ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছিল। সিটি ব্যাংক ১৯ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়ার পাশাপাশি ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছিল। এর পাশাপাশি ওয়ান ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক উভয় বোনাস দিয়েছিল। বাকি তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো শুধু বোনাস শেয়ার দিয়েছে। কিন্তু ২০১৬ সালে ১৪টি ব্যাংক নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল, আর ৫টি ব্যাংক উভয় লভ্যাংশ দিয়েছিল। নগদ লভ্যাংশ দেয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে আল আরাফা ২০ শতাংশ, ব্র্যাক ব্যাংক ১০ শতাংশ, সিটি ব্যাংক ২৪ শতাংশ, ডাচ বাংলা ব্যাংক ৩০ শতাংশ, এক্সিম ব্যাংক ১৫ শতাংশ, ইসলামী ব্যাংক ১০ শতাংশ, যমুনা ব্যাংক সাড়ে ২০ শতাংশ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ১৫ শতাংশ, এনসিসি ব্যাংক ১৬ শতাংশ, প্রাইম ব্যাংক ১৬ শতাংশ, স্যোসাল ইসলামী ব্যাংক ২০ শতাংশ, সাউথইস্ট ব্যাংক ২০ শতাংশ, ইউসিবিএল ১৫ শতাংশ এবং উত্তরা ব্যাংক ২০ শতাংশ।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, কৃত্রিম মুনাফার ওপর ভর করে নগদ লভ্যাংশ দেয়ায় তা ব্যাংকগুলোর জন্য সর্বনাশ ডেকে আনছে। কারণ, নগদ আদায় না করেও নগদে আদায় দেখিয়ে মুনাফা বাড়ানো হচ্ছে। এতে এক দিকে ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণ আড়াল হয়ে যাচ্ছে, অপর দিকে ব্যাংকের মূলধন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এতে সম্পদের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় আমানতকারীদের আমানত ফেরত দেয়ার মতো অর্থ ব্যাংকগুলোর কাছে থাকবে না। বিষয়টির প্রতি এখনই সংশ্লিষ্টদের নজর দেয়া উচিত বলে মনে করেন ওই কর্মকর্তা।