ময়মনসিংহমুখী বলাকা এক্সপ্রেস ট্রেনের নিচে আনুমানিক দেড় বছর বয়সী কন্যা শিশুকে নিয়ে ঝাঁপ দিলে ঘটনাস্থলেই শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে মারা যান ওই নারী। ট্রেনে কাটা পড়ে মা নিহত হলেও হাত তুলে মা মা বলে চিৎকারের সময় ট্রেনের আঘাতে দেড় বছর বয়সী শিশুটির বাম হাত থেঁতলে গেছে।
নিহতের নাম নাদিরা খাতুন (২৫)। তিনি নেত্রকোনা জেলার দূর্গাপুর থানাধীন কাকৈগড়া ইউনিয়নের বড় বাট্টা এলাকার শান্ত মিয়ার মেয়ে।
জানা যায়, শিশুটিকে কোলে নিয়ে বুধবার (১৩ অক্টোবর) সকালে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের গাজীপুরের শ্রীপুর রেল স্টেশনের উত্তরপাশের (কাঁটাপুল সংলগ্ন) এলাকায় ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েন তার মা। ট্রেনে কাটা পড়ে মা নিহত হলেও বেঁচে যায় ছোট্ট শিশুটি। এসময় দুই রেল লাইনের মাঝে মাথা তুলে ‘মা মা’ ডেকে দাঁড়ানোর সময় ট্রেনের আঘাতে হাত ও মাথার ক্ষত হয়ে যায় শিশুটির।
পরে স্থানীয় গৃহবধূ হাজেরা খাতুন শিশুর মায়ের ওড়না টেনে ক্ষতস্থান পেঁচিয়ে ধরে কোলে তুলে নিয়ে বাসা থেকে ফিডারভর্তি দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
গৃহবধূ হাজেরা খাতুন ও প্রত্যক্ষদর্শী নাছিমা খাতুন জানান, ময়মনসিংহমুখী বলাকা এক্সপ্রেস ট্রেনটি শ্রীপুর স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছিল। ঘটনাস্থলের দিকে যাওয়ার সময় চলন্ত ট্রেনটি বিরতিহীনভাবে হর্ন দিচ্ছিল। এ সময় এলাকার বিভিন্ন ঘরের ছেলে-মেয়েরা মক্তবে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে। কারও সন্তান রেল লাইনের ওপর চলে গেলো কি-না তা দেখার জন্য রেলপথের আশপাশের বাড়ির নারীরা ঘর থেকে বের হয়ে উঁকি দিচ্ছিলেন। ততক্ষণে ট্রেনটি ঘটনাস্থল অতিক্রম করে ফেলেছে। পরক্ষণেই দেখা যায়, রেল লাইনে রক্তাক্ত এক শিশু মাথা তুলে ‘মা মা’ বলে ডাকছে। সে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও পারছে না। শিশুটির মায়ের বিচ্ছিন্ন লাশ কাছেই পড়েছিল।
হাজেরা খাতুন বলেন, ‘চলন্ত ট্রেনের নিচে বেঁচে থাকাটা বিস্ময়ের। দৌড়ে কাছে গিয়ে দেখতে পাই, শিশুটির বাম হাতের বাহু থেকে কনুই পর্যন্ত কিছু মাংস থেঁতলে পড়ে গেছে। মাথায় রক্তাক্ত জখম হয়েছে। শিশুর মায়ের ওড়না টেনে ক্ষতস্থান পেঁচিয়ে ধরে কোলে তুলে নিই। বাসা থেকে ফিডারভর্তি দুধ নিয়ে খাওয়াতে খাওয়াতে শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসি। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়।’
উদ্ধারকাজে থাকা গৃহবধূ হাজেরা খাতুনের স্বামী আবু হানিফা শ্রীপুর খাদ্য গুদামের শ্রমিক। তিনি বলেন, ‘ভাইয়ের থেকে ১০ হাজার টাকা ধার নিয়ে বউকে দিয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে শিশুটিকে পাঠিয়েছি। এ সময় শ্রীপুর বাজারের অনেকেই চিকিৎসার জন্য কিছু কিছু আর্থিক সহায়তা দেন। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা কিছুটা চিকিৎসা দিয়ে ক্ষতস্থানে মাংস লাগানোর পরামর্শ দিয়ে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে রেফার্ড করেন।’ বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে শিশুটিকে নিয়ে তারা গাজীপুর অতিক্রম করেন।
আবু হানিফা জানান, তার একটিমাত্র ছেলে। বয়স সাত। শিশুটিকেও তার স্ত্রী ও তিনি সন্তানের মতো লালন-পালন করতে চান। যদি বৈধ অভিভাবক এসে নিয়ে যেতে চান সেক্ষেত্রে কোনও বাধা থাকবে না। তবে সৃষ্টির সেবা করতে এক শিশুর পাশে মানুষ হিসেবে দাঁড়ানোর কর্তব্যটুকু করতে পারার সন্তুষ্টি থাকবে আমৃত্যু।
শ্রীপুর স্টেশনের মাস্টার হারুনুর রশিদ জানান, সকাল সাড়ে ৬টায় ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী বলাকা এক্সপ্রেস ট্রেনের নিচে আনুমানিক দেড় বছর বয়সী কন্যা শিশুকে নিয়ে ঝাঁপ দেন এক নারী। ঘটনাস্থলেই নারীর শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে মারা যায়। স্থানীয়রা শিশুটিকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যায়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রেলওয়ে পুলিশের সদস্যরা নিহতের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে।
রেলওয়ে পুলিশের এসআই মো: শহিদুল্লাহ প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, বুধবার সকাল ৭টার দিকে শ্রীপুর রেলস্টেশন থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলরুটের কাটাপুল এলাকায় ৯ মাস বয়সের মেয়ে শিশুকে নিয়ে এক নারী (২৫) ঢাকা থেকে নেত্রকোনার জারিয়াগামী চলন্ত ট্রেন বলাকা এক্সপ্রেসের নিচে ঝাঁপ দেন। এতে ওই নারী ঘটনাস্থলেই মারা যান এবং তার সন্তানটি গুরুতর আহত হয়। স্থানীয়রা আহত শিশুটিকে উদ্ধার করে শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে ভর্তি করে। খবর পেয়ে রেলওয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহতের লাশ উদ্ধার করে। তাৎক্ষণিকভাবে নিহতের পরিচয় পাওয়া যায়নি। পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদস্যরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিকেলে নিহতের পরিচয় নিশ্চিত করেছেন।
শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা: মাহমুদা জানান, শিশুটির হাত থেকে গোশত খুলে গেছে। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা অথবা ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।