আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার শর্তে বেশ কিছু দফা তুলে ধরবে বিএনপি। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না-আপাতত এমন বার্তাই দেওয়া হবে। এসব দাবির পেছনে যৌক্তিক কারণও তুলে ধরা হবে। সরকার এসব দাবি পূরণে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে সরকার হঠানোর এক দফার আন্দোলনে যাওয়ার চিন্তা করছে দলটির হাইকমান্ড। পাশাপাশি আন্দোলন এবং নির্বাচনে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সমর্থন আদায়ে আগাম কিছু প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হবে। এ সংক্রান্ত রূপরেখার খসড়া তৈরি করছে দলটির নীতিনির্ধারকরা।
বিএনপির কেন্দ্রীয়, তৃণমূল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ মত যুক্ত করা হবে এসব খসড়ায়। এরপর স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে হবে বিস্তারিত আলোচনা। প্রাথমিক দফা ও প্রতিশ্রুতি যোজন-বিয়োজন করে তা চূড়ান্ত করা হবে। তবে দাবি ও প্রতিশ্রুতি এ দুটো বিষয় একসঙ্গে নাকি আলাদাভাবে তুলে ধরা হবে-তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আপাতত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারসহ বেশ কিছু দফা জাতির সামনে তুলে ধরার পক্ষে হাইকমান্ড। আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তা তুলে ধরা হবে। এতে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
সূত্র জানায়, জাতির সামনে এ রূপরেখা তুলে ধরার দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। দলের নির্বাহী কমিটি ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে বৈঠক শেষ করে তা চূড়ান্ত করার পক্ষে বেশিরভাগ নীতিনির্ধারক। এরপরই আনুষ্ঠানিকভাবে এসব দাবি তুলে ধরতে চান তারা। তবে শনিবার অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত আজ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানানো হতে পারে।
জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন পর বিএনপির ঘুম ভেঙেছে- এটা ভালো লক্ষণ। সকালের নাস্তা করে যদি ফের ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে কিছুই হবে না। এখন জেগে থাকতে হবে। দলের করণীয় চূড়ান্তে নেতাদের পাশাপাশি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও তাদের বসতে হবে। আন্দোলন কিংবা নির্বাচনে তারা কি করতে চায় এমন একটি রূপরেখা দ্রুত জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে।
তিনি আরও বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে এ দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে। এর বিকল্প হলে খুবই ভালো। যেমন আমি জাতীয় সরকারের একটা প্রস্তাব দিয়েছি। বিএনপিও একটা প্রস্তাব দিতে পারে। তারা যদি নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেয় সেটা খুবই ভালো কথা। তাদের কিছু না কিছু করতে হবে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে ভোটের আগে নিরপেক্ষ সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। তাই এখন থেকেই এ ব্যাপারে কাজ করতে হবে। তাছাড়া নির্বাচন কমিশন গঠনেও একটি রূপরেখা দিতে পারে বিএনপি। পাশাপাশি আন্দোলন বা নির্বাচনে যাওয়ার আগে জাতির সামনে কিছু প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। শুরুতেই বলতে হবে, ক্ষমতায় গেলে তারা প্রতিহিংসার রাজনীতি করবে না।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, দফার সংখ্যা কত হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। প্রাথমিকভাবে তৈরি খসড়ায় অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না- এমনটা ধরে নিয়েই তারা পরিকল্পনা তৈরি করছেন। কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করবে বিএনপি। প্রয়োজনে দল হিসাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও এ ইস্যুতে কথা বলার চিন্তা রয়েছে। দলটির নেতারা জানান, নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে তারা একটি স্থায়ী সমাধান চান। যাতে প্রতিবার ভোটের আগে এ ইস্যু নিয়ে ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। এ দাবির পেছনে যৌক্তিক কারণও তুলে ধরা হবে। দলীয় সরকারের অধীনে বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চিত্র তুলে ধরবেন তারা। নির্বাচন কমিশন বা প্রশাসনের ইচ্ছা থাকলেও দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে এমন ধারণা জন্ম নিয়েছে। তাই দিন দিন মানুষ ভোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। ভোট কেন্দ্রে কমছে ভোটার উপস্থিতি। মানুষকে ভোটকেন্দ্রমুখী করার একমাত্র পথ হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। ভোটের আগে এমন একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে ভোটারদের মনে আস্থা ফিরে আসে যে, তারা নিজের পছন্দমতো জনপ্রতিনিধি বেছে নিতে পারবেন। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসুক তা সাদরে গ্রহণ করা হবে বলেও জাতির কাছে প্রতিশ্রুতি দেবে দলটি।
দ্বিতীয় দফায় গুরুত্ব পাবে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন। জনগণের আস্থাভাজন একটি কমিশন গঠনে সব দলের সঙ্গে আলোচনা করার প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে। তবে তাদের আশঙ্কা যেভাবেই কমিশন গঠন করা হোক তা ক্ষমতাসীন দলের আজ্ঞাবহই হবে। তবে দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, নির্বাচন কমিশন গঠনকে তারা মূল ইস্যু করতে চান না। তাদের মতে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সেখানে ইসি যতই শক্তিশালী হোক তাদের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা কঠিন। তবুও এ ইস্যুকে সামনে রেখে কাজ শুরু করেছে দলটি। কমিশন গঠনের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। পাশাপাশি বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে যে ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দিয়েছিলেন তাদের মতামতও নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে তাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ শুরু হয়েছে। তাদের মতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। নির্বাচন কমিশন গঠন ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি বরাবর চিঠি দেওয়াসহ প্রয়োজনে আদালতে যাওয়ার বিষয়টিও ভাবা হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, নির্বাচনকালীন সরকার ও ইসি ছাড়াও আরও কিছু দফা জাতির সামনে তুলে ধরা হবে। এরমধ্যে রয়েছে, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তি। তার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করে তা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হবে। পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীসহ বিরোধী মতের বিরুদ্ধে করা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবিও জানাবে দলটি।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন আমরা বর্জন করলেও ২০১৮ সালের ভোটে অংশ নেই। তাই নির্বাচন নিয়ে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা সেই অভিজ্ঞতা আর চাই না। আমরা চাই, এ দেশের মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে। দলীয় সরকারের অধীনে তা কখনো সম্ভব হবে না। এজন্যই আমাদের মূল টার্গেট নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। সেই দাবিতে আমরা সময়মতো কর্মসূচি দেব।
সূত্র জানায়, নির্বাচনে যাওয়ার শর্তে দেওয়া বিভিন্ন দফার পাশাপাশি বেশ কিছু প্রতিশ্রুতিও জাতির সামনে তুলে ধরার পরিকল্পনা রয়েছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ঘোষিত ‘ভিশন ২০৩০’ কে ধরে তা চূড়ান্ত করা হচ্ছে। সেখানে যেসব প্রতিশ্রুতিগুলোর এখনো গুরুত্ব রয়েছে তা রাখা হবে। পাশাপাশি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি বিবেচনা করে যোগ করা হবে নতুন কিছু প্রতিশ্রুতি। নির্বাচনি ইশতেহারের আলোকে তৈরি করা হলেও এটাকে ইশতেহার বলা হবে না। আগামী দিনের আন্দোলন এবং নির্বাচনে সাধারণ মানুষ কেন বিএনপিকে সমর্থন করবে তেমন একটা বার্তা দেওয়া হবে। ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে মৌলিক কি পরিবর্তন আনতে চায় তার একটা আগাম ধারণা দেওয়াই এর মূল লক্ষ্য।
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন বলেন, সিরিজ বৈঠকের পর দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঙ্গাভাব তৈরি হয়েছে। আন্দোলনের জন্য সবাই প্রস্তুত। আমাদের লক্ষ্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। এর বাইরে আমরা কিছু ভাবছি না। এ দাবি আদায়ে শিগগিরই কর্মসূচি দেওয়া হবে। তার আগে জাতির সামনে দলের পক্ষ থেকে কিছু দাবি তুলে ধরা হতে পারে। তিনি বলেন, দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এ সরকারের নানা অনিয়ম, অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ। তারা প্রতিবাদ জানানোর সুযোগের অপেক্ষায় আছে। জনগণ একটি নেতৃত্ব চায়। আগামী দিনে বিএনপিই সেই নেতৃত্ব দেবে।