বাংলাদেশের আইনে প্রত্যেক নাগরিকের জীবন, সম্পদ ও সম্মান রক্ষার বিধান আছে; যা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু সার্বজনীন এ বিষয়টি আমাদের সাধারণ শিক্ষা কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত নেই। ফলে এ বিষয়গুলো কিছু আইনজীবী এবং কিছু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন ছাড়া অন্যরা খুব কমই জানেন। পরিণামে প্রায়ই হেনস্তা হতে হয়। দেশের শান্তিকামী নিরীহ নাগরিকেরা তাদের দিয়েই হেনস্তা হন, যাদের রক্ষা করার কথা। সেসব নিপীড়িত সাধারণ মানুষের জন্যই আমার লেখার এ প্রয়াস।
গায়েবি মামলা, আটক ও রিমান্ড সংক্রান্ত বিধান- ক. সাধারণ ব্যক্তি কর্তৃক মামলার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে- যেকোনো এলাকায় কোনো ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হলে যেকোনো ব্যক্তি, সংশ্লিষ্ট থানায় সে বিষয়ে মামলা করতে পারেন (ফৌজদারি কার্যবিধি ধারা-১৫৪)। তবে কুমতলবে কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত বা নজেহাল করার উদ্দেশে যদি মিথ্যা তথ্য দিয়ে কেউ এমন মামলা করে, তাহলে সে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে যাবে। এর শাস্তি ক্ষেত্রভেদে যেকোনো মেয়াদের কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে (দণ্ডবিধি ধারা-১৭৭, ১৮২, ১৯৩-১৯৫, ২১১)।
খ. আর পুলিশ কর্তৃক মামলার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে- যেকোনো অপরাধজনক ঘটনা সম্পর্কিত কোনো তথ্য গুজব, জনশ্রুতি অথবা টেলিফোনে থানাপুলিশ প্রাপ্ত হলে, তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমেই এজাহার দায়ের না করে তা জেনারেল ডায়েরি (জিডি)-তে লিপিবদ্ধ করে সরেজমিন আগে এর সত্যতা পরীক্ষা করতে হবে। অতঃপর তথ্যটি ভিত্তিমূলক বা সত্য বলে প্রতীয়মান হওয়ার পর যদি সেই তথ্যদাতাকে খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে থানার যেকোনো কর্মকর্তা নিজেই বাদি হয়ে সে বিষয়ে মামলা করতে পারেন। {পিআরবি ধারা-২৪৩(ঘ); এবং ডিএমপি রুলস : অধ্যায়-থানা, ধারা-৫৭ (৭)}।
পুলিশ কর্তৃক এ ধরনের ‘গায়েবি’ মামলা তাদের অপরাধমূলক কর্ম। সুতরাং সে মামলায় কাউকে গ্রেফতার করা শুধু ‘অবৈধ আটক’ বলেই বিবেচিত নয়, আইনের পরিভাষায় এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ। যার শাস্তির পরিমাণও ক্ষেত্রভেদে একেক রকম। সুতরাং তা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত কোনো ব্যক্তি পরিত্রাণের জন্য কোনো বৈধ ও সরকারি কর্তৃপক্ষের সাহায্য না পেলে আইনগতভাবে তিনি নিজেই আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। প্রচলিত আইন ও বিধি মোতাবেক থানায় মামলা দায়ের থেকে আদালতে বিচার হওয়া পর্যন্ত ধাপগুলো নি¤œরূপ : প্রথমত, থানায় অভিযোগ বা মামলা দায়ের; দ্বিতীয়, অভিযুক্তকে গ্রেফতার; তৃতীয়, ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতিক্রমে অভিযুক্তকে রিমান্ডে নেয়া; চতুর্থ, তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দেয়া; পঞ্চম, বিচারিক আদালত কর্তৃক রায় প্রদান। মিথ্যা বা গায়েবি মামলার ক্ষেত্রে এমন প্রতিটি স্তরের সৃষ্টিকারী পুলিশ। (এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ম্যাজিস্ট্রেটও) দায়ী বলে বিবেচিত হতে পারেন। এর বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে দণ্ডবিধি ১৮৬০ আইনে।
গৃহ তল্লাশি সম্পর্কিত আইনি বিধান
ক. পুলিশ কোনো নাগরিকের গৃহ তল্লাশি করতে পারে শুধু নি¤œবর্ণিত দুইভাবে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে- ০১. আদালত থেকে ইস্যুকৃত তল্লাশি পরোয়ানা। অথবা ০২. কোনো মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে সেই মামলার আসামি গ্রেফতার বা মালামাল উদ্ধার করে। খ. ফৌজদারি কার্যবিধি ১০৩ ধারা মোতাবেক গৃহ তল্লাশির পদ্ধতি ও নিয়ম- ০১. তল্লাশি শুরুর আগেই পুলিশ কর্মকর্তা স্থানীয় দুই বা ততোধিক সম্মানিত অধিবাসীকে সরেজমিন উপস্থিত থেকে, তাতে সাক্ষী হওয়ার জন্য প্রয়োজনে লিখিতভাবে অনুরোধ করবেন। ০২. তল্লাশিকালে গৃহকর্তা অথবা তার মনোনীত কোনো প্রতিনিধিকে অবশ্যই সাথে রাখতে হবে। ০৩. কাক্সিক্ষত কোনো মালামাল পাওয়া গেলে পুলিশ কর্মকর্তা তার একটি তালিকা প্রস্তুত করবেন। ০৪. এরপর সেই তালিকার একটি অনুলিপি চাহিদা মোতাবেক গৃহকর্তা বা তার প্রতিনিধিকে এবং সাক্ষীদের দেবেন।
গ. এই ধারা সম্পর্কে উচ্চ আদালতের ব্যাখ্যা- ০১. এই ধারা-১০৩ সংযোজন করাই হয়েছে এ কারণে যে, যেসব পুলিশ কর্মকর্তা তল্লাশি পরিচালনা করেন, তারা যাতে কোনো অসাধুতার আশ্রয় নিতে না পারেন। ০২. ‘সম্মানিত অধিবাসী’ বলতে তাকে বুঝানো হবে, যিনি নিরপেক্ষ এবং যাকে তল্লাশি স্থানের মালিক বা প্রতিনিধি বিশ্বাস করতে পারেন। ০৩. এ ধারার বিধানগুলো যথাযথ অনুসরণ করা ছাড়া কোনো গৃহ তল্লাশি বা কোনো সন্দেহভাজন মালামাল জব্দ করা অবৈধ বা বেআইনি কর্ম বলে গণ্য হবে। ঘ. পিআরবি : ২৮০ এবং ডিএমপি (তানা) রুলসের বিধি : ১০৬-এ গৃহ তল্লাশি সম্পর্কে বলা হয়েছে- (১) তল্লাশিকারী পুলিশ কর্মকর্তা গৃহকর্তার অজ্ঞাতসারে কোনো জিনিস ঘরে নেয়া বা বের করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করবেন। গৃহকর্তা বা তার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে তল্লাশি চালাতে হবে। তল্লাশির সাক্ষীদের উপস্থিতিতে কোথায় কোন্ জিনিসটি পাওয়া গেল, তা স্পষ্টভাবে দেখাতে হবে। তল্লাশিকালে যদি কোনো মালামাল পাওয়া না-ও যায়, তাহলে ‘জব্দকৃত কোনো মালামাল নেই’ মর্মে জব্দ তালিকা প্রস্তুত করে উপরোল্লিখিত একই পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্টদের এর অনুলিপি দিতে হবে। ০২. মামলার তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট নির্দিষ্ট কোনো জিনিস বিশেষ কোনো ব্যক্তির দখলে আছে বলে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গতভাবে যদি জানা যায়, তবেই কেবল সে ক্ষেত্রে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি চালানো যেতে পারে। অন্যথায় তল্লাশি পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি করা বেআইনি। তল্লাশিকালে প্রাপ্ত মালামাল তালিকাসহ ফৌজদারি কার্যবিধি-১৬৫ ধারা অনুযায়ী যথাশিগগির সম্ভব, তল্লাশিকারী পুলিশ কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠাবেন।
উল্লেখ্য, কোনো গৃহের দখলদার দাগী, দুশ্চরিত্র কিংবা ফেরারি আসামি- শুধু এই অজুহাতে সেই গৃহে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি চালানো যাবে না। ০৩. তল্লাশি শুরু করার আগেই উপস্থিত সাক্ষী, গৃহকর্তা বা প্রতিনিধির সামনেই তল্লাশিকারী প্রত্যেক পুলিশ কর্মকর্তা, তাদের সহকারী, সংবাদদাতা (যদি থাকে) প্রমুখের নিজ নিজ দেহ পরীক্ষা করে নিতে হবে। ০৪. এমন সৌজন্যের সাথে তল্লাশির ব্যবস্থা করতে হবে, যেন গৃহবাসীদের, বিশেষ করে মহিলাদের, তাতে যথাসম্ভব কম অসুবিধা ঘটে। ০৫. সাক্ষীরা যাতে সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষ বা পুলিশের সাথে সম্পর্কযুক্ত না হয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হন, সে বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে। যদি সম্ভব হয়, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার সদস্য অথবা এলাকার প্রধান ব্যক্তিকেও তল্লাশি কর্মকাণ্ড দেখার জন্য উপস্থিত রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই কোনো ‘সোর্স’ বা গুপ্তচর, অভ্যস্ত মদ্যপ বা সন্দেহভাজন চরিত্রের লোককে তল্লাশি সাক্ষী হিসেবে তলব করা যাবে না।
০৬. যখন বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের জন্য কোনো গৃহে তল্লাশি করার প্রয়োজন হবে, তখন অস্ত্র আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে অবশ্যই পরোয়ানা সংগ্রহ করতে হবে। বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের জন্য কোনো পুলিশ অফিসার নিজ উদ্যোগে গৃহ তল্লাশি করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত নন। তল্লাশিকারী কর্মকর্তা এমনভাবে তল্লাশি চালাবেন, যেন উপস্থিত সাক্ষীদের মনে এরূপ কোনো সন্দেহ করার কোনো অবকাশই না থাকে যে, তল্লাশিকারী পুলিশ কর্মকর্তা বা তাদের সঙ্গীরা গৃহকর্তাকে ফাঁসানোর জন্য কোনো জিনিস আগে থেকেই গোপনে ঘরে প্রবেশ করিয়ে রেখেছেন। মোটামুটি, এই হলো গৃহ তল্লাশি সম্পর্কিত আইনের বিধানাবলি।
সুতরাং সংশ্লিষ্ট কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যদি এ বিধানের ব্যত্যয় করে কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো কর্ম করেন তাহলে তা আইনবহির্ভূত বা বেআইনি কাজ বলে গণ্য হবে। ক্ষেত্রভেদে এর শাস্তি হতে পারে দুই থেকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
সঙ্গত কারণেই কোনো নাগরিক যদি এসব অপরাধ-অনাচার থেকে কোনো বৈধ বা সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো আশ্রয় না পান, তাহলে এমন বেআইনি ও অপরাধমূলক অপতৎপরতা থেকে বাঁচার লক্ষ্যে দণ্ডবিধি-১০৪ ধারা মোতাবেক, আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন।
অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক পদার্থ এবং মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত বিধান
ভুক্তভোগীরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন, তাদের হয়রানি করার উদ্দেশ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেরাই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক পদার্থ বা মাদকদ্রব্য তাদের দখলে রেখে অতঃপর সেই দখল রাখার অপরাধ দেখিয়ে তাদের ফাঁসিয়ে দেয়। এমন অভিযোগের সত্য-মিথ্যা তদন্তসাপেক্ষ হলেও বাস্তবতা হলো, অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাস করে থাকেন।
এ বিষয়ক সাধারণ বিধান হলো- যিনিই এসব অবৈধ দ্রব্যসামগ্রী নিজের বেআইনি দখলে রাখবেন, তিনি যে শ্রেণী ও পেশারই হোন না কেন, ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত এবং অতঃপর সাজাপ্রাপ্ত হবেন। সংশ্লিষ্ট আইনের ধারা : ০১. অস্ত্র আইনের ১৪ ধারায় অননুমোদিত কোনো আগ্নেয়াস্ত্র দখলে রাখাকে অপরাধজনক কাজ বলে বর্ণনা করে বলা হয়েছে, যিনি এমন রাখবেন তিনি ১৯ (চ) ধারা অনুযায়ী সাত বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্তÍ যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ০২. অনুরূপভাবে বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আইনের ৪ ধারায় বলা হয়েছে- যদি কেউ বেআইনিভাবে কোনো বিস্ফোরক পদার্থ দখলে রাখেন, কিংবা প্রস্তুত করেন, বা তদ্বারা কোনো বিস্ফোরণ ঘটান, তবে সেই ব্যক্তি তিন থেকে ২০ বছর পর্যন্তÍ যেকোনো মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন এবং ০৩. মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৯ ধারায় অ্যালকোহল ছাড়া অন্য সকল প্রকার মাদকদ্রব্যের চাষাবাদ, উৎপাদন, পরিবহন, আমদানি-রফতানি, ক্রয়-বিক্রয়, সরবরাহ, সংরক্ষণ, প্রয়োগ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলা হয়েছে- যে বা যিনি তা করবেন, তিনি এ আইনের ১৯ ধারায় উল্লিখিত শাস্তি অনুযায়ী যাবজ্জীবন বা ক্ষেত্রভেদে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
সুতরাং পুলিশ যদি কোনো ব্যক্তিকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে উপরোল্লিখিত কোনো দ্রব্য নিজে থেকে দিয়ে সেই মামলা প্রস্তুত করে বা গ্রেফতার-চার্জশিট দেয়, তাহলে সেই পুলিশ কর্মকর্তা নি¤েœাক্ত দুই ধরনের অপরাধে অপরাধী বলে সাব্যস্ত হবেনÑ প্রথমত, মিথ্যা মামলা সৃষ্টি, গ্রেফতারের নামে অন্যায় আটক এবং অসৎ চার্জশিট ইত্যাদি অপরাধ; যার ধারাগুলো আগেই আলোচনা করা হয়েছে এবং দ্বিতীয়ত, সে সব অবৈধ দ্রব্য পুলিশের নিজের দখলে রাখার অপরাধ। এর সাজা দ্রব্য বিবেচনায় অস্ত্র, বিস্ফোরক বা মাদক আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় হতে পারে।
ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা এবং ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা-
ক. পুলিশ আইনের ধারা : ২৩ ক-তে বলা হয়েছে, প্রত্যেক পুলিশ অফিসারের দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে- ০১. ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বৈধ ও আইনানুগ আদেশ পালন। ০২. নিজ দায়িত্বাধীন এলাকার শান্তিরক্ষা সম্পর্কিত সংবাদ সংগ্রহ এবং তৎপরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করা। ০৩. অপরাধ এবং অপরাধীদের শনাক্তকরণসহ তাদের আইনের আওতায় আনা। ০৪. যৌক্তিক ও আইনগতভাবে গ্রেফতারে বাধ্য, এমন ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা। (ডিএমপি ধারা-১৫)।
খ. ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৪৯-১৫১ এ বলা হয়েছে : যদি কোনো পুলিশ অফিসার কোথাও কোনো আমলযোগ্য অপরাধ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্রের খবর জানতে পারেন, তাহলে তিনি নিজে তা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেবেন অথবা নিজ সামর্থ্যরে অপ্রতুলতায় প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষ্যে তাকে তা জানাবেন। অতঃপর পুলিশ কর্মকর্তা যদি মনে করেন, ষড়যন্ত্রকারীদের গ্রেফতার ছাড়া এ অপরাধ নিবারণ করা যাবে না, তবে তিনি তাদের বিনা পরোয়ানায়ই গ্রেফতার করতে পারবেন। গ. মামলা (এজাহার) : ফৌজদারি কার্যবিধি ১৫৪ ধারায় বলা হয়েছে- নিজ দায়িত্বাধীন এলাকায় কোনো অপরাধ সংঘটনের নির্ভরযোগ্য সংবাদ পেলে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা সেই বিষয়ে কালবিলম্ব না করে এজাহার দায়ের করে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সংবাদদাতা সশরীরে উপস্থিত থাকলে তিনি বাদি হতে পারেন অথবা বিশেষ কোনো কারণে সংবাদদাতা বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যদি নিজে বাদী হতে অপারগতা প্রকাশ বা অস্বীকার করেন, তবে তাকে বাদি হতে বাধ্য করা যাবে না।
সে ক্ষেত্রে থানার যেকোনো পুলিশ কর্মকর্তা বাদি হয়ে এজাহার দায়ের করে সেই অপরাধ উদঘাটনের নিমিত্তে তদন্ত এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করবেন। তবে কোনো অপরাধজনক ঘটনা সম্পর্কিত কোনো তথ্য যদি গুজব, নেহায়েতই জনশ্রুতি অথবা টেলিফোনে প্রাপ্ত হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে প্রথমেই এজাহার দায়ের না করে তা জেনারেল ডায়েরিতে (জিডি) লিপিবদ্ধ করে সরেজমিন আগে তার সত্যতা পরীক্ষা করতে হবে। অতঃপর তথ্যটি ভিত্তিমূলক বা সত্য বলে প্রতীয়মান হওয়ার পর যদি সেই তথ্যদাতাকে খুঁজে না পাওয়া যায় (বা তথ্যদাতা যেকোনো কারণে নিজে বাদি হতে অস্বীকার করেন), তাহলে থানার যেকোনো কর্মকর্তা নিজেই বাদি হয়ে সে বিষয়ে মামলা করতে পারেন {পিআরবি নিয়ম-২৪৩ (ঘ); এবং ডিএমপি রুলস : অধ্যায়-থানা, ধারা-৫৭ (৭)}।
ঘ. তদন্ত ও গ্রেফতার : কোনো ফৌজদারি মামলার তদন্তকালে তদন্তকারী কর্মকর্তা তার প্রাথমিক তদন্তে যদি দেখতে পান, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সে অপরাধে জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, কেবল সে ক্ষেত্রেই তিনি ওই ব্যক্তিকে আইনানুগভাবে গ্রেফতার বা আটক করে সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠাতে পারেন। তবে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে, প্রাথমিক তদন্তে সংশ্লিষ্ট অপরাধের সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে বিশ্বস্ত ও গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত শুধু এজাহার নামীয় হলেই কোনো আসামিকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো সমীচীন নয়; বরং তা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এ ক্ষেত্রে পিআরবি নিয়ম-৩১৭ ন্যায়সঙ্গত ও মানবিকতার সাথে প্রয়োগ করতে হবে। অন্যথায়, তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির-৩৪২ ধারা অনুযায়ী অবৈধ আটকের অভিযোগ উত্থাপন করা যেতে পারে। পিআরবি নিয়ম : ৩১৭-এ বলা হয়েছে- অপ্রয়োজনীয় গ্রেফতার করা থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে পুলিশকে সতর্ক থাকতে হবে। যুক্তিসঙ্গতভাবেই মামলার ঘটনার সাথে জড়িত, প্রাথমিক তদন্তে এমন প্রমাণ না পাওয়া গেলে কাউকে গ্রেফতার করা উচিত নয় (ডিএমপি রুলস : অধ্যায়-থানা, ১৪৩)। আর জড়িত থাকা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হওয়ায় কোনো আসামিকে যদি গ্রেফতার করাও হয়, তবে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা-১৬৯ অনুযায়ী থানা থেকেই তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে জামিন দিয়ে দেবেন, অথবা পিআরবি নিয়ম-৩৪২ অনুযায়ী গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠাবেন।
ঙ. পুলিশ কর্তৃক মিথ্যা মামলা দায়ের : দণ্ডবিধি আইনের ১৯৩ ধারায় বলা হয়েছে- কোনো ব্যক্তিকে নাজেহালমূলক শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে যদি অপর কোনো ব্যক্তি (পড়–ন ‘পুলিশ’) ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা এজাহার উদ্ভাবন করেন, তা হলেই তার সাত বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার মতো অপরাধ হয়ে যায়। এজাহার দায়ের করার পরবর্তী আর কোনো কর্ম, যেমন- গ্রেফতার, রিমান্ড, মিথ্যা চার্জশিট দাখিল ইত্যাদি সম্পন্ন করার প্রয়োজন হয় না। এ সব অন্যায়ের জন্য রয়েছে পৃথক ধারায় শাস্তির ব্যবস্থা। আর সেই মিথ্যা এজাহার দায়ের করে তৎপরবর্তী কুকর্মগুলো সম্পন্ন হলে নিরপরাধ ব্যক্তিটির বিরুদ্ধে যদি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধের ধারায় সে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়, তা হলে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা ১০ বছর থেকে যাবজ্জীবন মেয়াদে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার মতো অপরাধ করে ফেলেন। সেই বানোয়াট চার্জশিটের পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালিত বিচারের পর আদালত নিরপরাধ ব্যক্তিকে যে শাস্তি প্রদান করেন, মিথ্যা এজাহারকারী সেই শাস্তি প্রাপ্তির যোগ্য হয়ে যান।
এ ক্ষেত্রে হতে পারে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মতো শাস্তি। দণ্ডবিধির ধারা ১৯৪ সে নির্দেশনাই দেয়। চ. ‘অপরাধ’ বলতে কী বোঝায় : ফৌজদারি কার্যবিধি ধারা-৪ (১) (গ)-এর বর্ণনানুযায়ী, যে কাজ বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য বলা হয়েছে, সে কাজ করা অথবা আইনানুগভাবে যে কাজ করতে কোনো ব্যক্তি দায়িত্বপ্রাপ্ত, সে কাজ থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিরত থাকাকে অপরাধ বলে। সুতরাং কোনো সরকারি বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি (পুলিশ), যার ওপর অপরাধ নিবারণ ও উদঘাটনের আইনি দায়িত্ব অর্পিত, তিনি যখন সে কাজ অসৎ উদ্দেশ্যমূলকভাবে তা করা থেকে বিরত থাকেন, তখন তা অপরাধ বলে পরিগণিত হয়।
ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা : ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা-৪ (৩)-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী থানার ‘ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’ বলতে কনস্টেবল পদের ওপরের পদধারী সেই কর্মকর্তাকে বোঝানো হবে, যিনি থানার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন, অথবা যিনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে তার দায়িত্ব পালন করবেন। যিনি তার নিজ দায়িত্বাধীন এলাকার মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ চিহ্নিতকরণ ও দমন অথবা তা উদঘাটনের লক্ষ্যে নিজে এবং তার অধীনস্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের শৃঙ্খলাসহ যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের জন্য দায়ী থাকবেন (পিআরবি-২০১ ও ২০৫; ডিএমপি রুলস : অধ্যায়-থানা, ধারা-৪ ও ৭)।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ঊর্ধ্বতন পদের কর্মকর্তাদের ‘সুপিরিয়র কর্মকর্তা’ বলা হয়।
ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা-৫৫১-এর বর্ণনা অনুযায়ী, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ দায়িত্বাধীন এলাকার জন্য থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মতো দায়িত্ব ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত বলে বিবেচিত হবেন। পরিসর ছোট হলে, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নিজে কাজটি করতে হয়, আর পরিসর বৃহত্তর হলে অধীনস্ত কর্মকর্তারা তার কাজটি আইনানুগ পন্থায় যথাযথভাবে করছেন কি না তা তদারকির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হয়। এখানেও অসৎ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হয়ে সেই তদারকি কর্ম থেকে নিজেকে বিরত রাখলে তিনিও অবধারিতভাবে ‘বিরত থাকার’ অপরাধে দায়বদ্ধ হয়ে যাবেন।
লেখক : ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ