এক নাটকে বদলে গেলো ময়মনসিংহের শেফালির জীবন

একটি নাটকে বদলে গেলো শেফালির জীবন। নানা বাধা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে চলছেন। ২০ বছরেই পেয়েছেন সফলতা। হয়ে উঠেছেন প্রতিবন্ধীদের মডেল।

সংগ্রামী জীবনের গল্পটি ময়মনসিংহ প্রতিবন্ধী আত্ম-উন্নয়ন সংস্থার কার্পেট কারখানার ডিজাইনার শেফালি আক্তারের (৪০)। বর্তমানে তার অধীনে কার্পেট ও শতরঞ্জি তৈরির কাজ করছেন অর্ধশতাধিক প্রতিবন্ধী নারী। এসব প্রতিবন্ধীর হাতের তৈরি পণ্য যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সসহ বিশ্বের নানা দেশে।

ময়মনসিংহ সদরের কিসমত গ্রামের ইব্রাহিম আলী ও ফাতেমা খাতুন দম্পতির ছয় সন্তানের মধ্যে পঞ্চম শেফালি। জন্ম ১৯৮১ সালে। দুই বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বর দেখা দেয়। জ্বর ভালো হওয়ার কিছুদিন পর পোলিও রোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসার অভাবে দুই পা অবশ হয়ে যায়। আর হাঁটা হয়নি। সেই থেকে হামাগুড়ি দিয়ে জীবন সংগ্রাম শুরু।

অভাবের সংসারে প্রাথমিক বিদ্যালয় পাসের পর আর লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। ২০০০ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর দিশেহারা হয়ে পড়েন। হতাশায় দিন কাটছিল। ওই সময় বাড়িতে বসে বিটিভিতে আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘ওরে বিহঙ্গ’ নাটক দেখে অনুপ্রাণিত হন। এই নাটক দেখেই বদলে যান শেফালি। হয়ে উঠেন সংগ্রামী। ২০০৪ সালে ময়মনসিংহ প্রতিবন্ধী সেন্টারে এসে প্রশিক্ষণ নিয়ে কার্পেটের কাজ শুরু করেন। কিছুদিন কাজ শেখার পর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়।

বর্তমানে মহানগরীর কাঁচিঝুলি প্রতিবন্ধী আত্ম-উন্নয়ন সংস্থায় কার্পেট ডিজাইন, কোয়ালিটি কন্ট্রোল এবং প্রোডাকশন ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করছেন। কারখানায় তার অধীনে প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিবন্ধী নারী কার্পেট, শতরঞ্জি তৈরির কাজে নিয়োজিত। ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৫ সালে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়ে ১৫ দিনের জন্য শেফালি ফ্রান্স সফর করেছেন।

শেফালি আক্তার বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর প্রতিবন্ধী হিসেবে পরিবারে অবহেলার শিকার হয়েছি। আমাকে কিছু একটা করতে হবে- এই চিন্তা-চেতনা সবসময় ছিল। ‘ওরে বিহঙ্গ’ নাটকে প্রতিবন্ধী লাভলীর শরীর অবশ থাকায় মুখ দিয়ে ছবি আঁকতেন। লাভলীর চরিত্রে রুমানা রশিদ ঈশিতা অভিনয় করেন। এই নাটক দেখার পর সিদ্ধান্ত নিই, চেষ্টা করলে আমিও জীবনে স্বাবলম্বী হতে পারবো।

তিনি বলেন, নাটকটি দেখেই নিজেকে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিই। কার্পেট কারখানায় কাজ শেখার পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। আয়-রোজগার করার সুবাদে পরিবারে একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া আমার সঙ্গে প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিবন্ধী নারী কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। কাঠ নির্মিত তাঁতে পুরোনো শাড়ি কাপড় ও সুতো দিয়ে কার্পেট এবং শতরঞ্জি তৈরি করতে পেরে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতিবন্ধীরা এখন স্বাবলম্বী। এতে আত্মতৃপ্তি পেয়েছি।

তিনি বলেন, কারখানায় প্রতিবন্ধীদের হাতে তৈরি দৃষ্টিনন্দন কার্পেট, শতরঞ্জিসহ পণ্য চলে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৫ সালে ফ্রান্স সরকার আমাকে আমন্ত্রণ করে একটি বিশ্ব প্রতিবন্ধী ফোরামে নিয়ে যায়। সেখানে আমি অতিথি হিসেবে বিভিন্ন দেশের প্রতিবন্ধীদের মতো কার্পেট তৈরি করে চমক দেখাই। এরপর আমাদের সংস্থা থেকে প্রতিবন্ধীদের তৈরি কার্পেট ও শতরঞ্জি ফ্রান্স ছাড়াও বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়।

আত্মবিশ্বাসী শেফালির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী আত্ম-উন্নয়ন সংস্থা এখন প্রান্তিক প্রতিবন্ধী নারীদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। নতুন নতুন মেয়েরা কাজ শেখার জন্য আসছেন।

প্রতিবন্ধী আত্ম-উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও প্রতিবন্ধীদের সংগঠক মো. শাহাদাত সারোয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নানা বাধা পেরিয়ে প্রতিবন্ধীদের মডেল হয়ে উঠেছেন শেফালি আক্তার। নিজের হাতে প্রতিবন্ধী নারীদের কার্পেট ও শতরঞ্জি তৈরির কাজ শেখান। কোনও সমস্যায় প্রতিবন্ধীরা তার কাছে এলে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন।

তিনি আরও বলেন, প্রতিবন্ধী হওয়ায় এবং পারিবারিক সমস্যা থাকায় লেখাপড়া বেশি করতে পারেননি শেফালি। তবে বর্তমানে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন। ২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে হয়নি।

Share this post

scroll to top